মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ কার্তিক ১৪৩১

আল মাহমুদের কবিতা বৃষ্টি হয়ে ঝরুক

আল মাহফুজ
  ০৫ আগস্ট ২০২৪, ১০:১৪
আল মাহমুদ

‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ

দুপুরবেলার অক্ত,

বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়

বরকতেরই রক্ত।

প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি

আমায় নেবে সঙ্গে,

বাংলা আমার বচন আমি

জন্মেছি এই বঙ্গে।’

‘একুশের কবিতা’। বিখ্যাত এই কবিতার জনক আল মাহমুদ। তার রচিত ‘নোলক’ কবিতাটিও পাঠ্যপুস্তকের বদৌলতে অনেকেরই পড়া হয়েছে। শৈশবের স্মৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যায় কবিতাটি। হয়তো তার চেয়েও বেশি কিছু, যা আমাদের ক্রমাগত নস্টালজিক করে তোলে। নোলকের দুয়েক ছত্র এখানে তোলা হলো–

‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে, হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।’

কবি আল মাহমুদ। তিতাস পারের কবি। গতকাল (১১ জুলাই) ছিল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম এই প্রধান কবির জন্মদিন। আর ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি। সেদিন ছিল শুক্রবার। অথচ কি আশ্চর্য, এমন ‘শুভ’ শুক্রবারের রজনী শেষেই ধরাধাম থেকে তিনি বিদায় নিতে চেয়েছিলেন! প্রকৃতি সম্ভবত তার ডাক শুনেছে। প্রকৃতি সম্ভবত কবিদের কথা শুনতে পায়। কি নিঠুর সেই সাধ পোরা সম্ভাষণ, আমরা একটু মিলিয়ে দেখি–

‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে

মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;

অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে

ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সক্রিয় থেকে আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে, শব্দরাশি ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। কবিতায় উপহার দিয়েছেন লোকজ ভাণ্ডার। শুধুমাত্র ‘সোনালী কাবিন’ লিখেই তিনি শিল্পের চূড়ায় অবস্থান করতে পারতেন। কিন্তু ‘লোক লোকান্তরে’র কলমের খোঁচায় সাজিয়ে তুলেছেন অজস্র ভাণ্ডার। কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যেও সমান বিচরণ করেছেন।

আল মাহমুদ একাধারে একজন কবি, ছড়াকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। জীবনানন্দ দাশের পর এতো বড় কবি বাংলা সাহিত্যে এসেছিলেন কিনা, সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। যুক্তি বা বাহাস চলতে পারে, চলুক। আমরা বরং তার অমর সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’-এর প্রথম সনেটটি পড়ি–

‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী

যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,

আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি

আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;

ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্ব্ন,

ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি;

দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন

আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি।

বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল

পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;

তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল

জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা

পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা;

দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’

ব্যক্তি আল মাহমুদ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। জীবনের ছুটে চলা ট্রেন কখনও ভুল স্টেশনে থেমেছে। কখনও বগি ঠিক করতে সময় একটু বেশি লেগেছে। তবু ছুটে চলেছে ট্রেন। তবু তার পদ্য-গদ্য আবেশ ছড়িয়েছে পাঠকমনে। এক বিন্দু আফসোস করার ফুরসত তিনি রাখেননি।

আমরা জানি, প্রতিটি ব্যক্তির কিছু না কিছু মানবীয় ক্ষুদ্রতা থাকে। আমরা সেভাবেই কবিকে বিবেচনা করতে চাই। শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কবিরও কি সকল ক্ষুদ্রতার সমাপ্তি ঘটে যায়? ব্যক্তি কবি যদি ক্ষুদ্রতার মাইলফলক পাড়ি দিতে না পারে, তবুও তার সৃষ্ট কবিতার মহত্ত্ব হারায় কি?

কবিতাকে ‘কবিতা’ হয়ে উঠতে হলে ‘যদি, কিন্তু, তবে’র পথ দিয়ে না হাঁটলেও চলে। তখন এগুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে। আল মাহমুদের কবিতাও তেমন। সেগুলো কারও ধার না ধেরেই কবিতা হয়ে ওঠে। তার ‘পানকৌড়ির রক্ত’ দেখে গল্পপাঠকের সম্বিৎ ফেরে। সেগুলো তখন আর অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে হাঁটে না। হাঁটার দরকার পড়ে না। আমরা মাহমুদে নন্দনতত্ত্বের যেমন দেখা পাই, তেমনি ফান্ডামেন্টাল রূপও অদেখা থাকে না।

তবে তাকে নিয়ে যতো সমালোচনাই থাকুক, বাংলা সাহিত্য মাহমুদকে মনে রাখবে তার অসীম কাব্য প্রতিভার ক্ষমতাবলে। মাহমুদের পিপাসার্ত কবিতা হয়তো বৃষ্টি হয়ে ঝরবে। আজকের মতো কোনো মেঘলা মেদুর দিনে সিক্ত করবে তপ্ত মাটিকে। সেগুলো সাদা কালো অক্ষর থেকে হয়তো পানকৌড়ির মতো ডানা মেলবে। অক্ষরগুলো বর্ণিল হোক অথবা বিবর্ণ, আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তার অজর কবিতায়, অসামান্য গদ্যে।

কবির জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাকে নিয়ে লেখাটির ইতি টানছি তার কবিতা ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ দিয়ে–

‘শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি

নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ

দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।

যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ

জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই

তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।

আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক

কত রাত তো অমনি থাকিস।

আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি

নিহত হয়ে থাকলাম।

অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ

আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী

মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। নাহার

কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।

আর আমি এঁদের ভাই

সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে

এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।

কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।

শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায়

শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ

লাল সূর্য উঠে আসবে। পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ

নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানোছিটানো

ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর

দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।

কলার ছোট বাগান।

দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা

একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,

ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান …।

বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসেফেলবেন।

ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে

ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ

ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।

আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে

ঘষে ঘষে

তুলে ফেলবো।’

যাযাদি/ এস

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে