চট্টগ্রামের ২০ এলাকার ১০ লাখ মানুষ ওয়াসার পানির সংকটে

প্রকাশ | ২৪ মে ২০২৫, ১৪:৩৪ | আপডেট: ২৪ মে ২০২৫, ১৪:৫৬

খোরশেদুল আলম শামীম, চট্টগ্রাম
পানি সংকটে চট্টগ্রাম ওয়াসা এলাকার লোকজন।।ছবি: যায়যায়দিন

‘মনে হয় মরুভূমিতেও মানুষ এত কষ্টে নাই। আমাদের এখানে পানি আসেনা নিয়মিত। সপ্তাহে দুই দিন পাই, অনেকসময় পানিতে থাকে ময়লা, দুর্গন্ধ। তবুও পানি ধরে রাখতে হয়। দূর থেকে টাকা দিয়ে পানি কিনে সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু সেই পানি আবার বালতি বা কলসি ভরে ৪ তলায় ওঠানোর মত কষ্ট কাকে বোঝাবো? রোজায় কি এভাবে সম্ভব?’

চট্টগ্রাম মহানগরীর আগ্রবাদ ব্যাপারীপাড়া স’ মিল এলাকার বাসিন্দা ইয়াসমিন জাহান এভাবে পানি নিয়ে ভোগান্তির কথা জানালেন।

ব্যাপারীপাড়া নয় শুধু, নগরীর আগ্রাবাদ, ছোটপোল, উত্তর ও দক্ষিণ হালিশহর, ইপিজেড, লালখান বাজার, অক্সিজেন, বায়েজিদ, বহদ্দারহাট, চকবাজার, আন্দরকিল্লাসহ প্রায় সকল এলাকার চিত্র। ওয়াসার পানির উৎপাদন কম হওয়ায় গত দুই মাস ধরে পানির সংকটে ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। সাধারণ মানুষ দুষছেন ওয়াসার অব্যবস্থাপনাকে।

জানা গেছে, চট্টগ্রামের ২০টি এলাকার অন্তত ১০ লাখ মানুষ ওয়াসার পানির সংকটে ভুগছেন। কোথাও কোথাও পানি সপ্তাহে দুই-তিন পানি আসে, কোথাও এলেও ঘণ্টাখানেক পর পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। চাকরিজীবী পরিবারগুলো পানি ধরে রাখার সুযোগ পায় না বলে ভোগান্তি থেকেই যাচ্ছে।

ওয়াসা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, বর্তমানে চট্টগ্রামে পানির চাহিদা দৈনিক ৫৬ কোটি লিটার, কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা ৫০ কোটি লিটার। ফলে প্রতিদিন ৬ কোটি লিটার পানির ঘাটতি থাকে। ওয়াসার পানির উৎসের ৯২ শতাংশ হালদা ও কর্ণফুলী নদী এবং ৮ শতাংশ গভীর নলকূপ থেকে।

গত এক মাস ধরে নদীতে পানির পরিমাণ কমে যাওয়ায় সরবরাহেও মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। এখন গড়ে প্রতিদিন আরও ৫ কোটি লিটার কমেছে পানি। ফলে মোট ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি লিটারে।

সংস্থার প্রকৌশলীদের মতে, রোজায় পানির চাহিদা আরও অন্তত ২ কোটি লিটার বাড়ে। অর্থাৎ মোট ঘাটতি ১৩ কোটি লিটারে গিয়ে ঠেকেছে। এই দুর্ভোগ কমাতে ওয়াসা চারটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও সাতটি বিশেষ দল গঠন করেছে।

পাশাপাশি, গভীর নলকূপগুলো প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এসব ব্যবস্থা নেওয়া হলেও ভুক্তভোগী নগরবাসী মনে করছেন, পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয়। প্রতি বছর রমজান মাসে একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও পানি সংকট থেকেই যায়।

নদীতে পানির সরবরাহ যখন স্বাভাবিক থাকে, তখন কর্ণফুলী পানি শোধনাগারের ইউনিট-১ ও ইউনিট-২ থেকে ১৪ কোটি করে মোট ২৮ কোটি লিটার, মদুনাঘাট পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার এবং মোহরা পানি শোধনাগার থেকে ৯ কোটি লিটার পানি পাওয়া যায়। গভীর নলকূপ থেকে যুক্ত হয় আরও ৪ কোটি লিটার পানি।

কিন্তু বর্তমানে কর্ণফুলীর দুটি ইউনিট থেকে দৈনিক ৩ কোটি লিটার করে কম পানি মিলছে, ফলে দৈনিক সরবরাহ কমে দাঁড়িয়েছে ৪৪ থেকে ৪৫ কোটি লিটারে। গ্রীষ্মের দাবদাহ বাড়তে থাকলে এই সংকট যে কোথায় গিয়ে ঠেকবে, সেটা সহজেই অনুমেয়।

ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী নুরুল আমিন জানান, নদীতে পানি কমে যাওয়া, নাব্য সংকট, শেওলা ও লবণের আধিক্যে উৎপাদন কমে গেছে। তা সত্ত্বেও রোজায় সরবরাহ ঠিক রাখতে ছয়টি পানিবাহী গাড়ি প্রস্তুত এবং গভীর নলকূপ চালু রাখা হয়েছে।

তবে, এতে সংকট মোকাবিলা সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, পানির সংকটে বিভিন্ন কারখানা, ওয়াশিং প্ল্যান্টগুলো ঠিকাদারদের মাধ্যমে ওয়াসা থেকে আগাম পানির বুকিং দিয়ে রাখে। সেই সাথে পানির বিলের বাইরে অতিরিক্ত টাকা খরচ করে বলে কারখানাগুলোতে পানি সরবরাহে অগ্রাধিকার দেয় পানিবাহী ভাউচারগুলো। এতে সাধারণ মানুষের পানির সংকট ক্রমশ দীর্ঘতরই হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চট্টগ্রামের মত বড় শহরে ওয়াসার পরিকল্পনা যথেষ্ট নয়। মাত্র ৫-৬টি পানিবাহী গাড়ি ও নিয়ন্ত্রণকক্ষ দিয়ে এত বড় শহরের সংকট দূর করা যাবে না। ৪১টি ওয়ার্ডের জন্য অন্তত ১৫টি পানিবাহী গাড়ি ও প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে নিয়ন্ত্রণকক্ষ থাকা উচিত। পুরো ওয়াসাকে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে মত দেন তারা।

নগরীর উত্তর নালাপাড়া, কোতয়ালী, পাথরঘাটা এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পানির সংকট। নিয়মিত পানি পাচ্ছেন না মানুষ। সাম্প্রতিক সময়ে সংকট আরও তীব্র হয়েছে। উত্তর নালাপাড়ার বাচুনি কলোনির বাসিন্দা আনোয়ারুজ্জামান জানান, গত এক সপ্তাহে তার বিল্ডিংয়ে পানি এসেছে মাত্র দুই বার। ভাড়াটেদের কথা ভেবে বিকল্প উপায়ে পানি কিনতে হয়েছে। এভাবে কতদিন সামাল দেয়া সম্ভব, প্রশ্ন রাখেন তিনি।

ওয়াসার পানির সংকটের ফলে অনেকে ভবন মালিক গভীর নলকূপ থেকে পানি তুলছেন বাধ্য হয়ে। এতে বিদ্যুৎ খরচ যেমন বাড়ছে, তেমনি ভূগর্ভস্থ পানির সংকট তীব্রতর হচ্ছে ক্রমশ। পানির স্তর সরে যাওয়ায় অনেক এলাকায় গভীর নলকূপ অকেজো হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও লবণাক্ত পানি মিলছে। ফলে সমস্যা সমাধান হচ্ছেনা কিছুতেই।