ফড়িয়াদের কব্জায় ধানের বাজার

মাঠে নেই প্রায় আড়াই হাজার চালকল হ দুই সপ্তাহে মণপ্রতি মোটা ধানের দাম কমেছে ২শ' টাকা হ সরকারি সংগ্রহ অভিযান পুরোদমে শুরু হয়নি

প্রকাশ | ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২১, ০৯:৫৪

ম আলতাব হোসেন

এবার সারাদেশে আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। মাঠে-ঘাটে-উঠানে সোনারঙা ধান হাসছে। তবে শ্রমে-ঘামে ফলানো ধান নিয়ে বাজারে গিয়ে মাঠের হাসি উবে যাচ্ছে কৃষকের। ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কৃষকের জীবনে অতিপরিচিত ঘটনা। এবারো তার ব্যতিক্রম হলো না। মৌসুমের দ্বিতীয় সপ্তাহে পড়তি দামের তেঁতো অভিজ্ঞতা কৃষকদের দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত করছে। লোকসানের গঁ্যাড়াকলে পড়েছেন প্রায় এক কোটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক। ফলন বেশি হওয়ায় বাজারে চাহিদা কমেছে। অনেক এলাকায় এখনো সরকারি আমন ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়নি। বাজারে বিক্রেতা বেশি থাকলেও ক্রেতা হাতেগোনা। হাটে তৃতীয় পক্ষ না থাকায় বিক্রেতা কৃষক ঠকছেন। ফড়িয়াদের কব্জায় চলে গেছে ধানের বাজার। মৌসুমের শুরুতেই ধানের বাজারে দরপতন চলছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা ধানের দাম মণপ্রতি ২শ' টাকা কমেছে। এতে হতাশ দেশের প্রায় দুই কোটি কৃষক। কারো কারো মাথায় হাত। গ্রামে-গঞ্জে কৃষকের ধান কিনে নিচ্ছে ফড়িয়া ব্যবসায়ীরা। তারা সরকারি ক্রয়মূল্যের চেয়ে কম দামে কিনছে কৃষকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে। বড় ও সচ্ছল কৃষকরা ধান না বেচে মজুত করতে পারলেও ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা ঋণের টাকা শোধ করতে ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন। কৃষকরা বলছেন, চালকল মালিক ও সরকারি গুদামে ধান না কেনার কারণে আমন ধানের ভয়াবহ দরপতন চলছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, চাল আমদানি অব্যাহত থাকার প্রভাব পড়ছে বাজারে। সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে চাল সরবরাহে ব্যর্থ প্রায় আড়াই হাজার চালকল মালিকের লাইসেন্স বাতিল, জামানত বাজেয়াপ্ত ও মিলের বিদু্যৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে চালকলগুলোকে বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে এসব চালকল এবার ধান কিনতে পারছে না। আবার অনেক চালকল মালিক ব্যাংক ঋণ পাচ্ছেন না। এসব সমস্যার প্রভাব পড়েছে বাজারে। ফলে রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে ঘাম ঝরানো ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। গত বছর যে সুরু বা চিকন ধান ১৩৫০ টাকা মণে বিক্রি হয়েছে। এবার মৌসুমের শুরুতে সেই চিকন ধান ১১৮০ থেকে ১২শ' টাকা বিক্রি হয়। গত বছর মোটাজাতের যে ধান এক হাজার টাকার বেশি দামে ধান বিক্রি হয়েছে, এবার তা ৭৫০ থেকে ৮৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নেত্রকোনা দুর্গাপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম বারমারি। কৃষক সুরেং হাজং বলেন, 'গত বুধবার ধানের বড় হাট দুর্গাপুর বাজারে শুকনা সাদা পাঞ্চা ধান ১২৫০ টাকা মণে বিক্রি করেছি। এর পরের বাজারে স্বর্ণা ধান বিক্রি করেছি ৮১০ টাকা মণে। এবার সরকার ১০৮০ টাকা দরে ধান কিনছে। নেতা ধরেও ধান দিতে পারিনি। এক চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোট দিলে সরকারি দামে সে ধান বিক্রি করে দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনে সে পাস করতে পারেনি। বাজারেও ধান কেনার লোক নাই। ধান কাটতে একজন কৃষি শ্রমিকের দিনে মজুরি দিতে হয়েছে ৭শ' টাকা। বাজারে ধান নিয়ে আসতে অটো ভাড়া খরচ গেছে প্রতিমণে ৫০ টাকা। দুপুরে খাবারও দিতে হয়েছে। একমণ ধান বেচে একজন শ্রমিকের এক দিনের মজুরি দিতে পারছি না।' রানীনগর উপজেলার আবাদপুকুর বাজারে ধান বিক্রি করতে আসেন আব্দুল জব্বার। তিনি বলেন, 'আগের বাজারে মোটা স্বর্ণা ধান সাড়ে ১১শ' টাকা মণে বিক্রি করেন। আর গতকাল বিক্রি করেছেন ১০৩০ টাকা। এক সপ্তাহে মোটা ধানের দাম প্রায় ১৫০ টাকা কমেছে। হুট করে দাম কমে যাওয়ায় হতাশ তিনি। নওগাঁর বড় ধানের মোকাম আবাদপুকুর হাট, মান্দা উপজেলার চৌবাড়িয়াহাট, মহাদেবপুর সদর ও উপজেলার মাতাজীহাট বাজারে মানভেদে মোটা ধানের দাম ২শ' টাকা মণে কমেছে।' এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক একেএম মনিরুল আলম যায়যায়দিনকে বলেন, এবার সারা দেশেই আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। সোমবার পর্যন্ত প্রায় ৫৪ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। এবার ৫৫ লাখ ৭৯ হাজার ৮১২ হেক্টর জমিতে এক কোটি ৪৭ লাখ ৫২ হাজার ২২০ টন উৎপাদনের টার্গেট রয়েছে। আশা করছি উৎপাদনের চেয়েও বেশি ফলন হবে। সরকার চাল কেনার ঘোষণা দিলেও বাজারে তার প্রভাব পড়ছে না। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটি এ বছর প্রতি কেজি আমন ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করেছে ২৭ টাকা। এই হিসেবে প্রতিমণ ধানের মূল্য হচ্ছে ১০৮০ টাকা। আর প্রতি কেজি চালের মূল্য ধরা হয়েছে ৪০ টাকা। কৃষকরা বলছেন, চালকল মালিকরা ধানের দাম কমানোর কৌশল হিসেবে হাটে নামছেন না। ময়মনসিংহের ফুলপুরের কাশিগঞ্জ বাজারে ধান নিয়ে এসেছেন কৃষক ছামেদ আলী। তিনি বলেন, 'পাইজাম ধান ৮৫০ টাকা মণে বিক্রি করছি। অথচ গত বছর এই শুকনো ধান ১৩শ' টাকা মনে বিক্রি করেছি। ধান বেচে অনেক লোকসান হচ্ছে।' বাজারে ধান নিয়ে এসেছেন কৃষক আলী হোসেন। সকালে ধান নিয়ে আসলেও সন্ধ্যায় বিক্রি করেছেন ধান। ধান নিয়ে বসে থাকলেও হাটে ক্রেতা নেই। তিনি লাল পাইজাম ১০২০ টাকা মনে বিক্রি করেছেন। একই হাটে বিআর-৪৯ জাতের ধান বিক্রি করেছেন- ৮৫০ টাকা মণে। মাগুরা, যশোর, বগুড়া, শেরপুর, টাঙ্গাইল, নেত্রকোনার কৃষকদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, তারা ধানের পড়তি দামে চরম ক্ষুব্ধ। বাজারে ক্রেতা না থাকায় লোকসানে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, মঙ্গলবার খাদ্য বিভাগের মাঠ কর্মকর্তাদের আমন সংগ্রহ দ্রম্নত সফল করতে তাগাদা দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যারা ধান কিনতে বিলম্ব করবে এবং সফল হতে পারবে না তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমন ধান ও চালের যৌক্তিক দামও নির্ধারণ করা হয়েছে। এখন বাজারে মোটা ধানের দাম সাড়ে ৮শ' টাকা। সেখানে সরকার ১০৮০ টাকায় ধান কিনছে। তিনি আরও বলেন, চিকন ধানের দাম খুব একটা কমেনি। তবে মোটা ধানের দাম কিছুটা কমেছে। সরকারি ধান কেনা পুরোদমে শুরু হলে ধানের বাজার আবার ঘুরে দাঁড়াবে।