শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মুদি দোকানে টিসিবির পণ্য নেপথ্যে সক্রিয় একটি চক্র!

লাইনে দাঁড়িয়েও খালি হাতে ফিরছেন ক্রেতা
রেজা মাহমুদ
  ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৯ জানুয়ারি ২০২২, ০৯:১১

ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকসেল থেকে সাশ্রয়ী মূল্যে পণ্য কিনতে রীতিমত যুদ্ধ করতে হয় সাধারণ মানুষদের। বাজারদরের চেয়ে অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ কম দামে এসব পণ্যের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় অন্তত কয়েক ঘণ্টা। কিন্তু পণ্যের ব্যাপক চাহিদার করেণে অনেক সময় দীর্ঘ অপেক্ষার পরও খালি হাতে ফিরতে হয় তাদের। রোববার সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীতে টিসিবির ভ্রাম্যমাণ বিভিন্ন বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে পণ্য না পেয়ে খালি হাতে ফিরে যাচ্ছেন অনেকেই। তাদের অভিযোগ, এক মাস আগেও ভিড় বেশি থাকলে প্রয়োজনের তুলানায় কম পণ্যে পাওয়া যেত; কিন্তু এভাবে খালি হাতে ফিরতে হতো না। বাজারের তেল, চিনি ও মসুর ডালের বেশি দাম থাকায় এখান থেকে একটি চক্র কম দামে পণ্য কিনে মুদি দোকানে বেশি দামে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এ কাজে নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষদের ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা আগে এসে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে সর্বোচ্চ পরিমাণে সব ধরনের পণ্য কিনে নিচ্ছেন। ফলে লাইনের শেষের দিকে অপেক্ষারত বড় একটি অংশ পণ্য কিনতে পারছেন না। রাজধানীর আজিমপুর এলাকার টিসিবির নির্ধারিত ট্রাকসেলে গিয়ে দেখা যায়, তিনটি লাইনে প্রায় শতাধিক মানুষ পণ্য কেনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন। এছাড়াও বেশকিছু মানুষ লাইনের আশপাশে রয়েছেন। এ সময় লাইনে দাঁড়ানো ফরহাদ জানান, গত বৃহস্পতিবার ভিড় বেশি থাকায় তিনি কোনো কিছু কিনতে পারেননি। তাই আজ সকাল ৯টায় এসেছেন। তখনই প্রায় ৫০ জনের বেশি মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে। অথচ এক-দেড় মাস আগেও ১০টার মধ্যে ১০-১৫ জনের বেশি মানুষ লাইনে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। এ সময় টিসিবি পণ্যের নিয়মিত বেশ কয়েকজন ক্রেতা অভিযোগ জানিয়ে বলেন, পাড়া-মহলস্নার অনেক মুদি দোকানেই এখন টিসিবির ভোজ্যতেল পাওয়া যায়। এছাড়াও টিসিবির পেঁয়াজ, মসুর ডাল ও চিনিও বিক্রি করছেন অনেকেই। সম্প্রতি একটি চক্র নিয়মিত কিছু লোকজনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে পণ্য সংগ্রহ করে মুদি দোকানে বিক্রি করে দিচ্ছেন। তারা অনেকেই দোকান থেকে টিসিবির সিলযুক্ত পণ্য কিনেছেন বলেও জানান। এদিকে টিসিবির ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে প্রতি কেজি চিনি ৫৫ টাকায়, মসুর ডাল ৬০ টাকায়, সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১১০ টাকায় এবং পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একজন ক্রেতা সর্বনিম্ন দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ কেজি পেঁয়াজ, দুই কেজি মসুর ডাল, দুই কেজি চিনি ও পাঁচ লিটার সয়াবিন তেল কিনতে পারেন। শুধু আজিমপুর নয়, রাজধানীর বেশকিছু এলাকার টিসিবির পণ্যের নিয়মিত ক্রেতাদের অভিযোগ, ইদানীং লাইনের সামনের দিকে প্রতিবারই বেশ কিছু পরিচিত মুখ দেখতে পান। যারা প্রত্যেকে গড়ে প্রায় ২ হাজার টাকার পণ্য কিনছেন, ৫ লিটার সয়াবিন তেল কিনেছেন। অথচ এসব ক্রেতার বেশিরভাগই নারী ও শিশু। এদিকে ক্রেতাদের তুলনায় ট্রাকে ৫ লিটারের বোতল সংখ্যা অর্ধেকেরও কম। এ বিষয়ে টিসিবির বিক্রয়কর্মীরা জানান, তারা নিয়ম মেনে পণ্য বিক্রি করছেন কিন্তু কে পণ্য নিচ্ছেন এটা তাদের বিষয় না। তবে এখানকার স্থানীয় বাসিন্দাসহ আশপাশের দোকানিরা জানান, বেশ কিছু মহিলা খুব সকালে এসেই রাস্তায় ছোট বাচ্চা রেখে জায়গা দখল করে রাখেন। পরে টিসিবির ট্রাক এলে তাদের দলের প্রায় ২০-২৫ জন মহিলা এসে বাচ্চা সরিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর বেশি কিছু বিক্রয় কেন্দ্রেই নিয়মিত এমন ঘটনা ঘটছে। এছাড়াও পণ্য কেনা ও লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে বিশেষ করে নারীদের মধ্যে তর্কবিতর্ক এমনকি হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। অভিযোগ রয়েছে, যারা প্রতিদিন পণ্য কিনতে আসেন তাদের পক্ষ নিয়ে স্থানীয় ওয়ার্ডের নেতাকর্মীর পরিচয়ে সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে হুমকি-ধামকিসহ খারাপ ব্যবহার করেন। এদিকে আজিমপুর, মিরপুর-১ এর আনসার ক্যাম্প ও ৬০ ফিট এবং আগারগাঁও এলাকার বেশকিছু দোকানে টিসিবির ভোজ্যতেল বিক্রি করতে দেখা গেছে। এসব দোকানি পাইকারি দামের থেকে কম দামে এসব পণ্য কিনে নিচ্ছেন। তবে তেলে টিসিবির সিলযুক্ত থাকায় তার সব গ্রাহকের কাছে এই তেল বিক্রি করেন না বলেও এক দোকানি জানান। তবে চিনি ও ডালজাতীয় পণ্য বিক্রিতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। এ বিষয়ে টিসিবির কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তারা কেবল রুটিন মেনে বরাদ্দকৃত পণ্য নিয়ে নির্দিষ্ট এলাকায় যান এবং পণ্য শেষ বা ক্রেতা না থাকলে চলে আসেন। তবে এ ব্যাপারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের মন্তব্য জানতে চাইলে সংস্থাটির সহকারী পরিচালক মো. শাহরিয়ার যায়যায়দিনকে বলেন, এখন পর্যন্ত এজাতীয় কোনো অভিযোগ তাদের কাছে আসেনি। তবে টিসিবির এসব ভ্রাম্যমাণ বিক্রয় কেন্দ্রগুলোতে তারা প্রায় পরিদর্শনে যান। নিয়ম মেনে সবাইকে পণ্য দেওয়া কিংবা পণ্যের মান কেমন তা যাচাই করা হয়। এদিকে টিসিবির এসব সাধারণ ও স্বল্প আয়ের অধিকাংশ ক্রেতার ভোক্তা অধিকার ও সংস্থাটির সেবা সম্পর্কে কোনো ধারাণা নেই। এছাড়াও কীভাবে অভিযোগ জানাতে হয় তাও জানেন না তারা। এ ব্যাপারে শাহরিয়ার বলেন, প্রত্যেকটি ভ্রাম্যমাণ পণ্যের ট্রাকেই ভোক্তা অধিকারের অভিযোগের জন্য জরুরি সেবা নম্বর দেওয়া রয়েছে। এছাড়াও এসব পণ্য যে মুদি দোকানে বিক্রি হয় এমন অভিযোগ বা তথ্য তার জানা নেই। যেহেতু কোনো দোকানের বিরুদ্ধে ভোক্তার অভিযোগ নেই তাই স্বপ্রণোদিত হয়ে অভিযান পরিচালনার জন্য তাদের আরও যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন রয়েছে। তবে এ বিষয়ে অধিদপ্তর দ্রম্নত খোঁজ নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলেও জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে