দেশের সর্ব দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী। এক সময় এই জেলার অর্থনীতি কৃষি ও মৎস্য নির্ভর হলেও দিন দিন শিল্প নির্ভর অর্থনীতির দিকে অগ্রসর হচ্ছে পটুয়াখালী। বিশেষ করে এ জন্য প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে পায়রা তাঁপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা সমুদ্র বন্দর এবং পায়রা সেতুর মত মেগা সব প্রকল্পের। গত এক দশকে তিনটি বৃহৎ উন্নয়ন কমকান্ড পুরো জেলার চিত্র পাল্টে দিয়েছে। আর সে কারনেই এই অঞ্চলের মানুষের কাছে ‘পায়রা’ শব্দটি একটি প্রাণ সঞ্চার জাগোনো শব্দ।
পটুয়াখালী জেলার নাম শুনলেই এক সময় ঝড় জলোচ্ছাসের কথা মনে পরতো। তবে সেই পরিস্থিতির এখন অমুল পরিবর্তন ঘঠেছে। পটুয়াখালীর নাম শুনলেই সবার কাছে এখন পায়রা সমুদ্র বন্দর, পায়রা তাপ বিদুৎ কেন্দ্র কিংবা দৃষ্টি নন্দন পায়রা (লেবুখালী) সেতুর কথা মনে পরবে। আর দক্ষিণ অঞ্চলের এসব মেগা প্রকল্পের নাম করন এবং উন্নয়ন অগ্রাধিকারে রয়েছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম। প্রতিটি উন্নয়ন প্রকল্প তিনি নিজে যেমন ভিত্তিপ্রস্তর করেছেন ঠিক তেমনি এগুলোর উদ্বোধনও করছেন নিজ হাতে। আর সর্বশেষ আগামী ২১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাঁপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের।
পায়রা তাঁপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রঃ
পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় ধানখালীতে প্রায় এক হাজার একর জমিতে নির্মান করা হয়েছে দেশের সর্ব বৃহৎ কয়লা ভিত্তিক ১৩২০ মেঘা ওয়াট তাঁপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পটুয়াখালীর পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক শাহ আব্দুল মওলা জানান, ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মানাধীন পায়রা ১৩২০ মেঘাওয়াট তাপ বিদুৎ কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন। আর ২০২০ সালের ১৫ মে থেকে পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ম ইউনিট উৎপাদন শুরু করে এবং ওই বছরের ডিসেম্বরে দুটি ইউনিটে মোট ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বক্ষমতা লাভ করে। অপরদিকে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ২য় ফেইজে আরও ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের কাজ চলছে। আশা করা যাচ্ছে যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ হবে। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২১ মার্চ পায়রা তাঁপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের শুভ উদ্বোধন করবেন। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ মালিকানায় তৈরী এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে নির্মানে ২.৪৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় নির্ধারণ করলেও কাজ শেষে প্রায় ১শ মিলিয়ন ডলারের মত কম ব্যয় হয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট তাপ বিদ্যৎ কেন্দ্রে জমি অধিগ্রহনে ক্ষতিগ্রস্থ ১৩০ পরিবারের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্প ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ উদ্বোধন করেছিলেন। সে সময় প্রধানমন্ত্রী ক্ষতিগ্রস্থ ১৩০ পরিবারের মাঝে বাড়ির চাবি হস্তান্তর করেন।
পায়রা সেতুঃ
এক সময় ঢাকা থেকে পটুয়াখালী এবং কুয়াকাটা পৌছোতে বেশ কিছু ফেরি পার হতে হতো। তবে সে সব এখন অতিত, সর্বশেষ পায়রা (লেবুখালী) সেতু নির্মান করায় এখন ঢাকা-পটুয়াখালী-কুয়াকাটা মহা সড়কে পদ্মা নদী ছাড়া অন্য কোন ফেরি পাড় হতে হয় না। এতদিন লেবুখালী ফেরিঘাট ছিল একটি বিরম্বনার স্থান, তবে সেতু নির্মান করায় সেই এলাকা এখন সমৃদ্ধ জনপথ এবং ভ্রমনের স্থানে পরিনত হয়েছে। পায়রা (লেবুখালী) সেতু কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২১ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনাফারেন্স এর মাধ্যমে লেবুখালী পায়রা সেতু উদ্বোধনের পর সেতুটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। ২০১৩ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী পটুয়াখালীর লেবুখালীতে এসে পায়রা নদীর ওপর নির্মিত এ সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট, ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ বিনিয়োগে ১১৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি নির্মাণ করা হয়। চীনের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘লনজিয়ান রোড এন্ড ব্রীজ কনেস্টাকশন’ এর নির্মান কাজ সম্পন্ন করেছে। ১৪৭০ মিটার দৈঘ্য এবং ১৯.৭৬ মিটার প্রস্তের এই ব্রীজটি ক্যাবল দিয়ে দুই পাশে সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে নদীর মাঝ খানে একটি মাত্র পিলার ব্যবহার করা হয়েছে। আর পিলারের নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও নিশ্চিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের কর্নফুলীর ব্রিজের আদলে নির্মিত দেশের ২য় তম ব্রীজ যা এক্সক্টা ডোজ ক্যাবেল সিস্টেম এ তৈরী করা।
পায়রা সমুদ্র বন্দরঃ
কৃষি ও মৎস্য নির্ভর কলাপাড়া উপজেলায় কলাপাড়া বর্তমানে বানিজ্যক উপজেলায় পরিনত হয়েছে। কারন এই উপজেলায় নির্মান করা হচ্ছে দেশের তৃতীয় পায়রা সমুদ্র বন্দর। ২০১৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বন্দরের ফলক উন্মোচন করেন। আর ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্স এর মাধ্যমে পায়রা বন্দরের আনুষ্টানিক পন্য খালাস কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। সে সময় ৫৩ হাজার টন পাথর নিয়ে ফরচুন বার্ড নামে একটি চীনা জাহাজ প্রথম পায়রা বন্দরে বহিঃ নোঙ্গর করে। আর সেই থেকে নিয়মিত বহিঃ নোঙ্গরে পন্য খালাস কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই বন্দর ব্যবহার করে আমদানী করা পাথর ব্যবহার হয় পদ্মা সেতুর নির্মানে। বর্তমানে রামনাবাদ চ্যানেলে প্রায় ১১ কিলোমিটার দীর্ঘ পায়রা সমুদ্র বন্দরের জেটি সহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মান কাজ চলছে। আর বন্দরকে কেন্দ্র করে সরকারী বেসরকারী বিনিয়োগে শিল্প প্রতিষ্টান গড়ে তুলতে কাজ করছেন অনেকেই। আর বর্তমানে এই বন্দর ব্যবহার করে নিয়মিত পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কয়লা আমদানি করা হচ্ছে।
পটুয়াখালী সহ দক্ষিণ অঞ্চলের সামগ্রিক এসব উন্নয়নে জেলার সার্বিক চিত্র পাল্টে যাচ্ছে। কুয়াকাটায় এখন দেশী বিদেশী পর্যটকদের পদচারনা বেড়েছে। ব্যবসায়ীক কাজে পায়রা বন্দর কিংবা সমুদ্র বন্দরে এসে অনেকেই কুয়াকাটায় অবকাশ যাপন করছেন। অবার অনেকে কুয়াকাটা ঘুড়তে এসে এই এলাকায় নতুন নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শুরু করার জন্য জমি কিনছেন।
পটুয়াখালী চেম্বার অব কমার্স এর সাবেক সভাপতি ও পটুয়াখালী পৌর সভার মেয়র মহিউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘আমাদের অনেক ব্যবসায়িক বন্ধুরা এই এলাকায় শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং মিল কারখানা গতে তুলতে চাচ্ছেন। অনেকেই জমি কিনে তা ডেভলপ করছেন। পাশপাশি পটুয়াখালীর আউলিয়াপুরে তৈরী হচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। সব মিলিয়ে আগামী কয়েক বছরে এই জেলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অনেক জেলাকে ছাড়িয়ে যাবে। ’
পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মোঃ কামাল হোসেন বলেন, ‘ সাম্প্রতিক বছর গুলোতে এই জেলার উন্নয়ন সকলের কাছে চোখে পরার মত। পটুয়াখালী হবে উন্নয়নের হাব। আগামী ২১ মার্চ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই জেলার কলাপাড়া উপজেলার ধানখালীতে পায়রা তাঁপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করবেন। শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রয়োজন জ্বালানী এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মানের ফলে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতহবে। প্রধানমন্ত্রীর সফরে দেশী বিদেশী অতিথীরা উপস্থিত থাকবেন, তারা দেখবে কিভাবে একটি জেলা উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাংলাদেশের তৃতীয় বানিজ্যিক জেলা হবে পটুয়াখালী।’
যাযাদি/এস