বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১
ইসলামপুরের পাইকারি কাপড়ের বাজার

ঈদ মৌসুমেও হতাশ ব্যবসায়ীরা

১০ হাজার কোটি টাকার বিকিকিনি ৩ হাজার কোটি টাকায় নেমেছে
আহমেদ তোফায়েল
  ১৮ এপ্রিল ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৮ এপ্রিল ২০২২, ০৯:১৭

ইসলামপুর দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার। সালোয়ার-কামিজ, শার্ট-প্যান্ট-পাঞ্জাবি, শাড়ি-লুঙ্গি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের থান ও গজ কাপড়ের বৃহৎ সম্ভার এখানে। মিলছে বিদেশি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কাপড়ও। ঈদ সামনে রেখে এখানকার পাইকারি বিক্রেতাদের পাশাপাশি খুচরা বিক্রেতারাও ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিন্তু ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরগুলোর তুলনায় এ বছরের বেচাকেনা খারাপ। খুচরা বিক্রেতারা তেমন না আসায় এখনো জমজমাট হয়ে ওঠেনি অনেক দিনের পুরনো এ বাজারটি। ১১ রমজান পর্যন্ত প্রত্যাশিত ক্রেতা পাননি ব্যবসায়ীরা। ফলে গত দুই ঈদে হওয়া লোকসান কাটিয়ে ওঠার আশা ক্ষীণ হয়ে আসছে তাদের কাছে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এই বছরের বিক্রি এখন পর্যন্ত ঈদের নিয়মিত বিক্রির অর্ধেকেরও কম। শবেবরাতের এক সপ্তাহ আগে থেকে শুরু করে রমজানের শুরু পর্যন্ত ইসলামপুরে ঈদের বিক্রি আশাব্যঞ্জক ছিল। দেশের বিভিন্ন এলাকার খুচরা বিক্রেতারা ওই সময়ে যে পণ্যগুলো নিয়েছিল তা তারা পুরোপুরি বিক্রি করতে পারেননি। যার কারণে ঈদ মৌসুমের বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তবে বিক্রেতারা আশা করছেন, ১৫ রমজানের পর শপিংমলে ভিড় বাড়বে। তখন ইসলামপুরে পাইকারি অর্ডার বাড়তে পারে। বাংলাদেশ ক্লথ মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নেছার উদ্দিন বলেন, 'রমজানের শুরু থেকেই বেচাকেনা কম ছিল। এখনো প্রত্যাশিত বেচাবিক্রি নেই। তবে তার আশা ঈদের আগে বিক্রি বাড়বে। সমিতির তথ্যমতে, বুড়িগঙ্গার তীরে পুরান ঢাকার ইসলামপুরে প্রায় ৯৫টি মার্কেটে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি শোরুম রয়েছে। রাস্তার ধারের ছোট অস্থায়ী দোকান বিবেচনা করা হলে এ সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৬০ থেকে ৭০ হাজার জনবল সম্পৃক্ত। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদুলফিতরের বাজারে বার্ষিক ব্যবসার প্রায় ৬০ শতাংশ বিকিকিনি হয়। কিন্তু কারোনা অতিমারি পরপর দুই বছর ধরে তাদের বিক্রি খেয়ে ফেলেছে। পিক সিজন সাধারণত শবেবরাতের দশ দিন আগে শুরু হয় এবং তা রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে থাকে। পাকিজা ফেব্রিক্স কালেকশনের ইনচার্জ দিদারুল ইসলাম জানান, তারা ঈদ উপলক্ষে ৮০%-৯০% পণ্য বিক্রি করেন। তবে এবার তেমন গতি দেখা যাচ্ছে না। এখানে প্রতি গজ কাপড় এখন ৬৩ টাকা, যা গত বছর ৫২-৫৩ টাকা ছিল। খুচরা বিক্রেতারা বেশি দামে কাপড় কিনে শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে পারবেন কি না সে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। ইসলামপুরের লায়ন টাওয়ারের নিউ ত্রিনা এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক দেলোয়ার হোসেন জানান, 'ঈদের বিক্রির সময় কথা বলার ফুরসত থাকত না তাদের। কিন্তু এই রমজানে ব্যতিক্রম।' প্রতিটি শোরুমের মাসিক ভাড়া এক লাখ টাকা উলেস্নখ করে তিনি বলেন, ঈদের মৌসুম নিস্তেজ হয়ে গেলে মালিকদের টিকে থাকা কঠিন হবে। এস নাহার ম্যানশনের হিরো টেক্সটাইলের ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, 'নিয়মিত ও ভালো ব্যবসা মানে দিনে ৪০ হাজার গজ কাপড় বিক্রি, যা এখন মাত্র ২০ হাজার গজে এসে দাঁড়িয়েছে।' বাংলাদেশ ক্লথ মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শামসুল আলম বলেন, 'ইসলামপুরের ঈদুলফিতরে স্বাভাবিক সময়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হয়। কিন্তু করোনার কারণে ২০২০ সাল থেকে বিক্রি ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি হয়নি। সমিতির সাধারণ সম্পাদক নেছার উদ্দিন বলেন, মহামারি অনেক ব্যবসায়ীকে ব্যবসা থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। পুরান ঢাকার ইসলামপুর দেশের বৃহত্তম পাইকারি কাপড়ের বাজার। দোকানে দোকানে মিলছে একখন্ডের ডায়না ওড়না থেকে শুরু করে ছাপা শাড়ি, হাতে রং করা শাড়ি, কম্পিউটারে ডিজাইন করা শাড়ি, বোরকা, লুঙ্গিসহ আরও অনেক কিছু। শতাধিক ধরনের পণ্যসামগ্রী পাওয়া যায় ইসলামপুরের দোকানগুলোতে। তবে সর্বাধিক বিক্রি হচ্ছে পোশাক। এর মধ্যে আবার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় দেশি থ্রিপিস। ঈদ উপলক্ষে ঢাকা সিটি করপোরেশন টং মার্কেট, হাজি শরফুদ্দিন ম্যানশন, হাজি ইউসুফ ম্যানশন, আমানউলস্নাহ কমপেস্নক্স, হাজি কে হাবিবুলস্নাহ কমপেস্নক্স মার্কেট, লতিফ টাওয়ার, আহসান মঞ্জিল (মিউ.) সুপার মার্কেট, এ মাবুদ রাইন টাওয়ার, লায়ন টাওয়ার, মদিনা ভবন, হাজি শামসুদ্দিন ম্যানশন, ২৪ নম্বর মসজিদ মার্কেট নুরজাহান ম্যানশন, হালিম পস্নাজা, সোনার বাংলা মার্কেটসহ আশপাশের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো বাহারি পোশাকে সুসজ্জিত। বেচাকেনা চলছে খুব কম। মোড়ে মোড়ে মালপত্র ওঠানো-নামানো হচ্ছে। হাবিবুলস্নাহ কমপেস্নক্স মার্কেটের ব্যবসায়ী আরিফুর রহমান জানান, রাজধানীর গাউসিয়া থেকে শুরু করে নিউমার্কেট, বিভিন্ন বুটিক, ফ্যাশন হাউসসহ দেশের সব প্রান্তে যাচ্ছে ইসলামপুরের থ্রিপিসসহ বিভিন্ন পোশাক। যাচ্ছে বিদেশেও। নবাববাড়ি এলাকার আল-আমিন স্টোরের বিক্রেতা মাসুদ বলেন, 'এখন বেশি বিক্রি হচ্ছে থ্রিপিস ও পাঞ্জাবি।' ইসলামপুরের পোশাকের দোকানগুলোতে মান ও কাজ ভেদে ৬৫০ টাকা থেকে আড়াই হাজার টাকায় মিলছে দেশি থ্রিপিস। সেলাই ছাড়া থ্রিপিস মিলছে ৫৫০ থেকে ১৫০০ টাকায়। নানা কারুকাজ ও রঙের পাঞ্জাবি মিলছে ৩৫০ থেকে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। মিম ফ্যাশনের বিক্রেতা খাদেমুল হক বলেন, ভারত, পাকিস্তানের সুপার মডেল আর জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রীদের পরনে যে পোশাক দেখা যায়, হুবহু সেই থ্রিপিস এখানকার মার্কেটে পাওয়া যায়। রং ও ডিজাইন দেখে দুটি পোশাকের মধ্যে পার্থক্য বোঝার উপায় নেই। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশি কাপড়ে ডিজাইনার ও কারিগররা এসব থ্রিপিস তৈরি করেন। দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় ভারত-পাকিস্তানের থ্রিপিসের চেয়ে এখানকার থ্রিপিসের চাহিদা বেশি। ইসলামপুর মূল সড়কের দু'পাশের মার্কেটে রয়েছে কয়েকশ শাড়ি কাপড়ের দোকান। মাঝামাঝি স্থানের মার্কেটে বিক্রি হয় চাদর, থ্রিপিস, সু্যট ও মার্কিন কাপড়। প্রতিষ্ঠানগুলো এখন মূল সড়ক ছাপিয়ে আশপাশের সড়ক এবং লেনেও স্থান করে নিয়েছে। আশেক লেন, সৈয়দ আওলাদ হোসেন রোডসহ নবাববাড়িতে রয়েছে বিশাল সব কাপড়ের মার্কেট। ইসলাম পস্নাজা, হাজি কে হাবিবুলস্নাহ মার্কেটে পাওয়া যাচ্ছে দেশি-বিদেশি শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি ও নারীদের জামার গজ কাপড়। হোসেন মার্কেটের ঠিক সামনেই রয়েছে ঐতিহ্যবাহী আহসান মঞ্জিল (মিউ.) সুপার মার্কেট। এখন চায়না মার্কেট নামেই সর্বাধিক পরিচিত। এক কালার, সালোয়ার-কামিজ, আনস্টিচ থ্রিপিস, পাজামা-পাঞ্জাবি, শার্ট, সু্যট, প্যান্ট, বোরকার গজ কাপড় ছাড়াও দেশি পর্দা ও সোফার কভারের কাপড়ের দোকান। পাওয়া যাচ্ছে গার্মেন্ট ক্যাটাগরির গজ কাপড়। গজ কাপড়ের আরেক মার্কেট গুলশান আরা সিটি। এখানকার শোরুমগুলোতে মিলছে শিফন জর্জেট, টিসু্য, ভেলভেট, জিন্সসহ ডেনিমের গজ কাপড়। চাদরের গজ কাপড় মিলছে দৌলত কমপেস্নক্স এবং ভারতীয় আনস্টিচ থ্রিপিসের জন্য হায়াৎ দোলন কমপেস্নক্স বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ। আদেল কমপেস্নক্স, হাকিম ম্যানশন, আমির মার্কেটসহ বেশ কিছু মার্কেটে রয়েছে দেশি শাড়ি-কাপড়ের দোকান। পাকিজা, নন্দিনী প্রিন্ট শাড়ি কাপড়ের শোরুম রয়েছে এই মার্কেটগুলোতে। জাকাতের শাড়ি কাপড়ও পাওয়া যায় এখানকার দোকানগুলোতে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে