গম নিয়ে অনিশ্চয়তায়ও তীব্র হবে না সংকট

প্রকাশ | ১৬ মে ২০২২, ০০:০০ | আপডেট: ১৬ মে ২০২২, ০৯:০৯

ম যাযাদি রিপোর্ট

ভারত সরকারিভাবে গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণা দেয়নি সরকারের পক্ষ থেকে এমন বক্তব্য দেওয়া হলেও দেশের বাজারকে প্রভাবমুক্ত রাখা যায়নি। খুচরা বাজারগুলোতে হু হু করে গমজাত পণ্যের দাম বাড়ছে। এদিকে ভারত থেকে চুক্তিবদ্ধ গম আনা সম্ভব হলে, দেশের মাঠের নতুন গমের ফলন ও তিন-চার মাস পর পশ্চিম ইউরোপের দেশ, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ফলন আসলে বাজারে গমের সংকট হবে না বিশ্লেষকরা এমন আভাস দিলেও অনিশ্চয়তা কাটছে না। তবে কার্যকরী পদক্ষেপে সংকট সমাধানের দুটি পথও বেরিয়ে আসছে। জানা গেছে, রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের কারণে ইউক্রেনে গম উৎপাদন মারাত্মক ব্যাহত হচ্ছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দামও বাড়তে থাকে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে প্রতি টন গমের দাম ছিল ২৬৪ ডলার। নভেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৩৫ ডলার। ২০২২ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে তা বেড়ে হয় ৫৩৩ ডলার। এপ্রিলে তা আরও বেড়ে হয় ৬৭৩ ডলার। গত ১৩ মে তা বেড়ে ১ হাজার ১৭৮ ডলারে দাঁড়ায়। ইউক্রেন ছাড়াও রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে মিত্রদেশগুলো রাশিয়া থেকে গম আমদানি করতে পারছে না। ফলে ভারত থেকে গম আমদানিতে ঝুঁকেছিল বিশ্বের বহু দেশ। কিন্তু দেশটির স্থানীয় বাজারে গমের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধিতে শেষ পর্যন্ত গম রপ্তানি বন্ধের পথে হাঁটল ভারত সরকার। অভ্যন্তরীণ বাজারে গমের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাময়িকভাবে পণ্যটি রপ্তানি বন্ধের কথা জানিয়েছে ভারত। তবে শুক্রবার বা তার আগে গম রপ্তানিতে যেসব দেশের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে সেগুলো বহাল থাকবে। শুক্রবার রাতে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্য অধিদপ্তরের এই ঘোষণা প্রকাশ পাওয়ার পর দেশের গমের বাজারে ব্যাপক প্রভাব পড়ে। ফলশ্রম্নতিতে রোববার খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেন, বেসরকারিভাবে বন্ধ হলেও ভারত সরকারিভাবে গম রপ্তানি বন্ধ করেনি। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গম বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্যশস্য। দেশে বছরে প্রায় ৭৫ লাখ টন গমের চাহিদা রয়েছে। গমের ১১ লাখ টনের মতো দেশে উৎপাদিত হয়। বাকিটা আমদানি করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে গত ১ জুলাই থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে মোট ৫৫ লাখ ৪৬ হাজার টন গম দেশে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের গম আমদানি দাঁড়াবে ৭৫ লাখ টন। অন্যদিকে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশটি নিজেদের ২০২১-২২ অর্থবছরের ১১ মাসে (এপ্রিল-ফেব্রম্নয়ারি) প্রায় সাড়ে ৬৬ লাখ টন গম রপ্তানি করেছে, যার ৫৭ শতাংশেরই গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ। এমনি অবস্থায় ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করেছে এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজধানীর বাজারে বেড়ে যায় গমজাত পণ্যের দাম। অনেকেই আবার বেশি করে গম কিনে রাখতে শুরু করেছেন এমন তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। গম নিয়ে চতুর্মুখী দুশ্চিন্তার মধ্যে এখন সর্বমহলে আলোচনা হচ্ছে, এর প্রভাব কতটা পড়তে পারে। এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মত হচ্ছে, নতুন বাজারের সন্ধান করতে হবে। যদিও এজন্য পরিবহণ খরচ বাড়বে। ফলে গম ও গমজাত পণ্যের দামও বাড়বে। তবে আপাতত তেমন সংকট হবে না। তাদের মতে, ভারত থেকে চুক্তিবদ্ধ গম আনা সম্ভব হলে আগামী ৩-৪ মাস গমের সংকট হবে না। এর মধ্যে বাংলাদেশের মাঠেই দেখা দিবে নতুন গমের ফলন। এছাড়াও তিন-চার মাস পর পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের ফলন আসবে বাজারে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনার মাধ্যমে গম আমদানি অব্যাহত রাখতে পারবে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। তবে সমস্যা হচ্ছে বেসরকারি খাত নিয়ে। বাংলাদেশের সিংহভাগ গম বেসরকারি খাতে আমদানি হয়। বিশ্লেষকদের মত ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গম নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলেও ততটা তীব্র হবে না সংকট। কারণ, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের আগে বাংলাদেশ কখনই গমের জন্য ভারতের ওপরে সিংহভাগ নির্ভর ছিল না। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে ৪৫ শতাংশ গম আমদানি করেছে। বাংলাদেশের গম আমদানির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে কানাডা। বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে কানাডা থেকে ২৩ শতাংশ ও ভারত থেকে ১৭ শতাংশ গম আমদানি করেছে। এছাড়া বাকি ১৫ শতাংশ গম অন্যান্য মাধ্যম থেকে আমদানি করেছে বাংলাদেশ। তবে চলতি বছরের ফেব্রম্নয়ারি শেষার্ধে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার সংঘাত শুরু হলে বন্ধ হয়ে যায় গম আমদানি। এক্ষেত্রে গম আমদানির জন্য বাংলাদেশকে ঝুঁকতে হয় ভারতের দিকে। মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ কেবল ভারত থেকে ৬৩ শতাংশ গম আমদানি করেছে। কানাডা ও অন্যান্য মাধ্যম থেকে যথাক্রমে ১৪ ও ২৩ শতাংশ গম আমদানি করেছে বাংলাদেশ। ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) জানিয়েছে দুটি ক্ষেত্রে গম রপ্তানি করা যাবে। প্রথমটি হচ্ছে ইতিমধ্যে খুলে ফেলা যেসব ঋণপত্র (এলসি) বাতিলযোগ্য নয়, তার বিপরীতে। অপরটি খাদ্য ঘাটতিতে থাকা দেশের সরকারের অনুরোধের বিপরীতে ভারত সরকার অনুমতি দিলে। দুটো বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সুবিধা বাংলাদেশ কাজে লাগাতে পারলে গম সংকট থেকে মুক্তি পাবে বাংলাদেশ। সরকার যথাযথ উদ্যোগ নিলে রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার এ ধাক্কা কাটাতে সমস্যা হবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে সংবাদ মাধ্যমে বিএসএম গ্রম্নপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, এ জন্য সরকারকে দুটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে প্রথমে চুক্তি করা গম যাতে আসে, সে ব্যবস্থা নিতে হবে। আর গমের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় মূল্য বেঁধে দিতে পারে। এটি হলে ডলারের দামের জন্য এখন যে কেজিপ্রতি ৮-১০ টাকা দাম বেড়ে যাচ্ছে, তা হবে না।