বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ডলার নিয়ে চরম সংকট

বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মূল্যে ডলার পাওয়া যাচ্ছে না এলসি খুলতে পারছেন না ব্যবসায়ীরা আবেদন করেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার পাচ্ছে না অনেক ব্যাংক রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে আমদানি করা সব পণ্য দেশে আসছে কি না খতিয়ে দেখার তাগিদ
আহমেদ তোফায়েল
  ১৮ মে ২০২২, ০০:০০
আপডেট  : ১৮ মে ২০২২, ০৯:০৩

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে থেকে তৈরি পোশাক এনে রাজধানীর বিভিন্ন বিপণি বিতানে সরবরাহ করেন ব্যবসায়ী আলী আহমেদ। এজন্য তাকে প্রতি মাসেই ৮-১০ কোটি টাকার ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হয়। এতদিন ব্যাংকাররাই তার কাছে আসতেন এলসি খোলার জন্য। এখন ব্যাংকারদের কাছে ধরনা দিয়েও এলসি খুলতে পারছেন না তিনি। এ পরিস্থিতি শুধু আলী আহমেদের একার নয়। বরং দেশের ছোট বড় ও মাঝারি মানের আমদানিকারকরা ঋণপত্র খুলতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন। ডলারের প্রয়োজন মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের শরণাপন্ন হচ্ছে অনেক ব্যাংক। তাতেও সংকট কাটছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, প্রয়োজন অনুযায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে কিছু ব্যাংক। কিন্তু আবেদন করেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে অনেকে ডলার পাচ্ছে না, এমন অভিযোগও রয়েছে। বিষয়টি অবহিত করার জন্য গভর্নরের কাছে চিঠিও পাঠিয়েছে একটি ব্যাংক। আমদানি ব্যয় যে হারে বাড়ছে, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে বৈদেশিক মুদ্রার আয় হচ্ছে সে তুলনায় কম। এতে চাপে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে। এ অবস্থায় গাড়িসহ বিলাসপণ্যের আমদানিতে ৭৫ শতাংশ এলসি মার্জিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপরও এ সময়ে যাতে আমদানি দায় পরিশোধে কেউ যেন ব্যর্থ না হয়, সে লক্ষ্যে ব্যাংকগুলোর কাছে প্রচুর ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। গত ১০ মে দুই কোটি ১০ লাখ ডলার বিক্রির মধ্য দিয়ে চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০৩ কোটি ডলার। এর বিপরীতে বাজার থেকে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি উঠে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এর আগে কোনো এক অর্থবছরে এত পরিমাণ ডলার বিক্রি হয়নি। জানা গেছে, গত অর্থবছর উদ্বৃত্ত ডলার থাকায় বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে রেকর্ড ৭৯৪ কোটি ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে একের পর এক রেকর্ড হতে থাকে। গত বছরের জানুয়ারিতে ৪২ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার থেকে আগস্টে রিজার্ভ দাঁড়ায় ৪৮ দশমিক শূন্য ছয় বিলিয়ন ডলারে। গত মঙ্গলবার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) ২২৪ কোটি ডলারের দায় পরিশোধের পর রিজার্ভ ৪২ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। দেশের আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত (৯ মে) প্রতি ডলারের মূল্য ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা। যদিও এ দামে কোনো ব্যাংকেই ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যাংকগুলো বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ডলারপ্রতি ৯০-৯৬ টাকা পর্যন্ত আদায় করছে। আর মাঝারি ও ছোট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আদায় করছে তারও বেশি। এ ক্ষেত্রে প্রতি ডলারের মূল্য ৯৮ টাকা পর্যন্ত ঠেকছে বলে জানা গেছে। গত সোমবার মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান আবারও কমিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ৮০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৭ টাকা ৫০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যবসায়ী আলী আহমেদ জানিয়েছেন, ব্যাংক কর্মকর্তারা তাকে বলছেন, বাজারে ডলার নেই। এজন্য এলসি খোলা কঠিন হয়ে পড়েছে। চাপাচাপি করলে ব্যাংকাররা যে দর বলছেন, সে দরেই ডলার কিনতে হচ্ছে। গত সপ্তাহে তাকে ৯৬ টাকা দরে ডলার কিনতে হয়েছে। একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীরা জানিয়েছেন, মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ৯৫ টাকা দরেও রেমিট্যান্স কিনতে হচ্ছে। ব্যাংক তো গ্রাহকদের কাছে লোকসানে বিক্রি করতে করবে না। ব্যাংকের স্বার্থে বড় ব্যবসায়ীদের কেনা দামেও ডলার দিতে হচ্ছে। রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই '২১-মার্চ '২২) ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেশি। রেকর্ড আমদানির এলসি দায় পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে দেশের বেশির ভাগ ব্যাংক। এতে ডলারসহ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক সাবেক গভর্নর ডক্টর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ নানা কারণ মিলিয়ে বহুমাত্রিক সমস্যায় আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। এতে পণ্যের দাম বেড়ে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর চাপ তৈরি হয়েছে। রিজার্ভের ওপর যেভাবে চাপ তৈরি হয়েছে, তা দুশ্চিন্তার বিষয়। সাবেক এ গভর্নর বলেন, আমদানি খরচ এত বেড়ে গেল কেন, আবার আমদানি করা সব পণ্য দেশে আসছে কি না, তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি দেশে মানসম্মত যেসব খাদ্যপণ্য ও কসমেটিক উৎপাদন করা হচ্ছে, সেগুলো আমদানির ক্ষেত্রে উচ্চ শুল্ক আরোপ করা যেতে পারে। আবার দেশ থেকে এখনো যেভাবে টাকা পাচার হচ্ছে, এটা আশঙ্কাজনক। টাকা পাচার থামাতে কঠোর হতে হবে সরকারকে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্রম্নত টাকার মান কমানো উচিত। তিনি বলেন, 'শুধু এলসি খোলার ক্ষেত্রে উচ্চ মার্জিন আরোপ করে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা দূর করা যাবে না। বাজারে ডলারের চাহিদাকে মাথায় রেখে দ্রম্নত স্থানীয় মুদ্রার প্রয়োজনীয় অবমূল্যায়ন অপরিহার্য।' অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ শামস-উল ইসলামের ভাষ্য, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতির কারণে রেমিট্যান্স পাওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েছে অনেক ব্যাংক। তিনি বলেন, 'বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য উপায় খুঁজে বের করা উচিত।' মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতি টাকার আরও অবমূল্যায়নের দাবি রাখে। তিনি জানান, যেসব ব্যাংকের রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় ভালো, তারা অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় আছে। যে অংকের আমদানি এলসি এরই মধ্যে খোলা হয়েছে, সেগুলো নিষ্পত্তি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ব্যাংক বিলাসপণ্য আমদানির লাগাম টানার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে দেখতে হবে, মোট আমদানি পণ্যের মধ্যে এ ধরনের পণ্যের অংশ কতটুকু। আগামী দিনগুলোয় আমদানি দায় ও বিদেশি ঋণ পরিশোধে বড় ধরনের চাপ তৈরি হবে। খুচরা বাজার থেকেও ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের দর বেড়ে যাওয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন না মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, কার্ব মার্কেটের তুলনায় ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের চাহিদা অনেক বেশি। ব্যাংক বড় অঙ্কের ডলার একসঙ্গে কেনে এবং বিক্রি করে। চাহিদা বেশি হওয়ায় এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোর কাছ থেকে ৯৪ টাকারও বেশি দামে ব্যাংকগুলো ডলার কিনতে বাধ্য হচ্ছে। দেশের রপ্তানি খাতে বড় প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ফলে অর্থবছরের প্রথম নয় মাসেই সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতি তৈরি হয়েছে ১৪ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের ঘাটতিও ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রেমিট্যান্সের মন্দাভাবের পাশাপাশি আমদানি প্রবৃদ্ধির চাপ সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রপ্তানি আয়ের যে প্রবৃদ্ধি সেটি আমদানি ব্যয়ের তুলনায় খুবই কম। এ কারণে দেশের বাণিজ্য ঘাটতি রেকর্ড উচ্চতায় গিয়ে ঠেকেছে। করোনাভাইরাস সৃষ্ট আর্থিক দুর্যোগ, ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক নানা কারণে জ্বালানি তেল-গ্যাসসহ খাদ্যপণ্যের দাম এখন আকাশচুম্বী। শিগগিরই এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে এমন কোনো অবস্থাও দেখা যাচ্ছে না। ফলে সরকারের চলতি হিসাব ও ব্যালান্স অব পেমেন্টের বিদ্যমান ঘটতি বছর শেষে আরও বড় হবে। আগামী দুই বছর একই পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকলে দেশের অর্থনীতিতে দুর্যোগ নেমে আসতে পারে। একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক মইনুল ইসলামের ভাষ্য, এ বছরই দেশের আমদানি প্রায় ৮২-৮৫ বিলিয়ন ডলারে চলে যাবে, কিন্তু রপ্তানি প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। এই ৩২-৩৫ বিলিয়ন ডলারের যে বাণিজ্য ঘাটতি সেটা তো রেমিট্যান্স দিয়ে পূরণ করা যাবে না। ফলে এ বছরই ১০ বিলিয়ন ডলারের একটা ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে। তিনি বলেন, 'গত ৮ মাসে রিজার্ভের ৪৮ বিলিয়ন ডলারের যে হিসাব তা ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। পরের ২ মাসে এটা আরও ৪ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে। এভাবে যদি আমদানি রপ্তানির তুলনায় বাড়তে থাকে এবং সেটা যদি রেমিট্যান্স দিয়ে পূরণ করতে না পারি তাহলে অতি দ্রম্নত আমাদেরও রিজার্ভ শেষ হয়ে যাবে। রিজার্ভ বিপজ্জনক লেভেলে চলে গেলে টাকারও দাম কমবে। সেক্ষেত্রে আমাদের অর্থনীতিতেও একটা বিপদ আসবে, সব কিছুর দাম বেড়ে যাবে। এখন যে স্বস্তির অবস্থানে আমরা আছি সেটা বেশি দিন থাকবে না।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে