‘প্রভাবশালী চক্র প্রতিটি পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে’

প্রকাশ | ০৬ জুন ২০২৩, ১২:০৯

সাখাওয়াত হোসেন
প্রতীকী ছবি

দেশে উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পর সরকার বেশকিছু পণ্যের আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এর পরপরই ভেল্কিবাজির মতো এসব পণ্যের দরপতন ঘটেছে। অর্থনীতিবিদ ও বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, এসব ঘটনা থেকে খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্যের মূল্যস্ফীতির নেপথ্যে বাজার কারসাজির মুখ্য ভূমিকার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। 
 
তাদের ভাষ্য, প্রভাবশালী চক্র প্রতিটি পণ্যের বাজারে পৃথক সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে। তারা সুযোগ পেলেই নানা অজুহাতে বিভিন্ন পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলে নিজেদের ফয়দা লুটছে। যা নিয়ন্ত্রণে সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রশাসন বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে মে মাসে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়েছে। যা গত এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ৫ জুন সোমবার বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এ তথ্য জানিয়েছে। এর আগে গত বছরের আগস্টে সর্বোচ্চ ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে পৌঁছেছিল ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের মূল্য প্রকাশের এই সূচকটি। মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৪০ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশে। এপ্রিলে তা ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। খাদ্যবহির্ভূত মুদ্রাস্ফীতিও বেড়েছে। এটি গত মাসে ২৪ বেসিস পয়েন্ট বেড়ে ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে, যা এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ৭২ শতাংশ।

পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ডক্টর হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দেশে মূল্যস্ফীতির একাধিক কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান, আমদানিজনিত চাপ ও বাজার কারসাজি উল্লেখযোগ্য।

এ ছাড়া বাজার ব্যবস্থাপনায়ও দক্ষতা কম দেখা গেছে। চলমান মূল্যস্ফীতির কারণে বাংলাদেশের স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো তাদের প্রকৃত আয়, খাদ্য নিরাপত্তা এবং প্রয়োজনীয় খরচের ক্ষেত্রে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামলে অর্থনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানো অনেক পরিবারের জন্যই বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

খাদ্য মূল্যস্ফীতি কমাতে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরবরাহ পর্যায়ে যাতে কোনো ঘাটতি তৈরি না হয়, তা নিশ্চিত করা জরুরি দাবি করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এখনই কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলতে পারে।

অর্থনীতিবিদরা অনেকেই মনে করেন বাজার সিন্ডিকেটকে নিয়ন্ত্রণ করা গেলে সরবরাহ পর্যায়ে ঘাটতি দূর করা সম্ভব হবে। সেই সঙ্গে অবৈধ মজুতদারি বন্ধ করতে হবে। এ চক্রই বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে। অথচ নানা ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও গোষ্ঠী স্বার্থের কারণে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা নিয়ন্ত্রণে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছেন না। এমনকি তেল-গ্যাসের মতো যেসব খাত সরকারের নিজের নিয়ন্ত্রণে, সেসব খাতেও আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যহ্রাসের সুবিধা জনগণকে দেওয়া হচ্ছে না। এসব বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে না পারলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ্বালানি বিক্রির নামে জনগণের অর্থ লুণ্ঠন বন্ধ হবে না।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেন বলেন, মূল্যস্ফীতি সহনীয় রাখা এবং খাদ্যদ্রব্য ও ভোগ্যপণ্যের দামের লাগাম টেনে ধরার অস্ত্র সরকারের কাছেই আছে। তার ভাষ্য, প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতিটা খুব বিস্তৃত। আমদানি করা পণ্যে, দেশে উৎপাদিত পণ্যে কিংবা যেসব পণ্য বা সেবা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ঢোকে না, সব ধরনের পণ্যের ক্ষেত্রেই মূল্যস্ফীতির লক্ষণটা দেখা যাচ্ছে। তাহলে কিভাবে আমরা বলতে পারি, শুধু আন্তর্জাতিক মূল্যবৃদ্ধিই আমাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির কারণ। 

এদিকে অর্থনীতিবিদরা মূল্যস্ফীতির জন্য বাজার কারসাজি, চাহিদা এবং সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান, বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, আমদানিজনিত চাপ ও অবৈধ মজুতদারিসহ যা কিছুকেই দায়ী করুক না কেন বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে ভিন্ন কথা। 

দেশে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি পাঁচ বিষয়কে শনাক্ত করেছে। এগুলো হলো- রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব পণ্যের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে দেশের বাজারে পণ্যমূল্যের ঊর্ধŸগতি। দেশে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও করোনার পর থেকে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি। 

দেশের হালনাগাদ সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে এটি টাকার প্রবাহ বৃদ্ধিজনিত কারণে হয়নি। বেশির ভাগই হচ্ছে আমদানিজনিত কারণে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণেও মূল্যস্ফীতির হার বাড়ছে। এ ছাড়া গ্যাস-বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, এখন যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে তা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের খুব বেশি কিছু করার নেই। কারণ এখন যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে তা টাকার প্রবাহ বৃদ্ধিজনিত কারণে হয়নি। তিনি আরও বলেন, সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে বলে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে, এটাও ঠিক না। মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বিশ্ব বাজারে তেলের দাম, গ্যাসের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে।

বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির যে অজুহাত তুলে মূল্যস্ফীতি বাড়ার কথা বলা হলেও তা যে সঠিক নয়, তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। এর উদাহরণ তুলে ধরে তারা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, পাম তেল, চিনি, আটা তৈরির গম, পেঁয়াজ, মসুর ডাল, ছোলা ও মটরের ডাল- এই আটটি পণ্যের দাম রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর সময়কার তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও দেশের বাজারে তার কোনো সুফল পাওয়া যায়নি। পেঁয়াজ কিংবা সয়াবিন তেলের দাম বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে উল্টো বেড়েছে। চিনির দাম বিশ্ববাজারে যা বেড়েছে, দেশে বেড়েছে তার দ্বিগুণ। ডালের দাম বিশ্ববাজারে যে হারে কমেছে, দেশে সে হারে কমেনি।

এদিকে সম্প্রতি সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) দেশের চারটি খাদ্যসামগ্রীর অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মূল্যের পার্থক্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম কমেনি। উপরন্তু কিছু প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর দাম আন্তর্জাতিক দামের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে বেশি থাকছে।

সিপিডি যে চারটি খাদ্যপণ্য নিয়ে গবেষণা করেছে, তার মধ্যে চাল ও গরুর মাংস মূলত অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদিত হয়, আর সয়াবিন তেল ও চিনি প্রধানত আমদানি করা হয়। দেখা গেছে, বাংলাদেশে এ চার সামগ্রীর দামই আন্তর্জাতিক মূল্যের তুলনায় ধারাবাহিকভাবে বেশি থাকছে। 

ইরি-বোরো, পাইজাম, নাজিরশাইল-মিনিকেট ব— এসব ধরনের চালের দামই সমমানের থাই ও ভিয়েতনামি চালের দামের চেয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশি।

চিনির বাজারেও যে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, তা বাজার পর্যবেক্ষকদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে ভারতীয়দের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি দামে চিনি কিনতে হচ্ছে। সরকার যখন ব্যবসায়ীদের কথামতো চিনির দাম কেজিপ্রতি ১২০ টাকা ঘোষণা করে, তার আগে থেকেই দেশের বাজারে চিনি ১৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছিল। অভিযোগ রয়েছে, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে চিনির এই অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো হয়েছে। চিনি-সংকটের পেছনে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক বাজারে চিনির দাম বাড়ানোর কথা বলা হলেও এর নেপথ্যে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বেসরকারি আমদানিকারকদের ওপর একক নির্ভরশীলতা। যা বাজার কারসাজিকে সহজ করেছে।

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ধান-চালের বাজারে সবচেয়ে প্রভাবশালী পক্ষ হিসেবে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ করছেন চালকল মালিকরা। কৃষক, ফড়িয়া, আড়তদার, চালকল মালিক ও চালের খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ও অস্বাভাবিক মুনাফা করেন চালকল মালিকরা। তারা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে ৮ থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করছেন।

একইভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যসামগ্রীর ওপর কতিপয় বৃহৎ গ্রুপ অব কোম্পানি ও মিলমালিকদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কারণে তারা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা পরিস্থিতির অজুহাতে ইচ্ছামতো পণ্য আমদানি ও উৎপাদনের পরিমাণ এবং এসবের মূল্য হ্রাস-বৃদ্ধি করছে বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ করেন।

যাযাদি/এস