দিন দিন রিজার্ভ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ 

প্রকাশ | ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১১:০৮

সাখাওয়াত হোসেন

গত এক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমছে। সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩০৭ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক নিয়মে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, গত ২৬ সেপ্টেম্বর তা দুই হাজার ১১৫ কোটি ডলারে নেমে আসে। এর চার দিন পর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিনে এটি ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে এসে ঠেকেছে।

যদিও অর্থনীতি-বিষয়ক গবেষকরা মনে করেন, রিজার্ভের হিসাবে বড় রকমের ঘাটতি রয়েছে। তাদের ভাষ্য, বাংলাদেশের ডলারের হিসাবে প্রকৃত চিত্র আসছে না। যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংকট আরও বাড়াচ্ছে। রিজার্ভের সঠিক হিসাব থাকলে এবং এর নেগেটিভ টার্নিং ঠেকাতে সময়মত বিশেষজ্ঞদের সমন্বিত পরামর্শ নেওয়া হলে এই পরিস্থিতির কিছুটা হলেও উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হতো।

অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কা, যেভাবে প্রতি মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমছে, এতে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের সংকটের দিকে এগোচ্ছে। রিজার্ভের এই পতন ঠেকানোর জন্য নানারকম উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবে খুব বেশি কাজ আসেনি। ফলে সেটি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বরং জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন হওয়ায় এ সময় সরকার অর্থনীতিতে বড় ধরনের বা শক্ত কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবে না। ফলে আগামী কয়েক মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে রিজার্ভ পজিটিভ দিকে টার্ন করানোটা সরকারের জন্য এখন অনেক বড় চ্যালেঞ্জ।
এ জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত বৈদেশিক বিনিয়োগ আনার পথ উন্মুক্ত করতে হবে। যদিও সেটা যুক্তরাষ্ট্রের সুদহার, ইউরোপের সুদহার, তাদের মূল্যস্ফীতি ও যুদ্ধসহ অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। কারণ, তাদের নীতি দেশে বিনিয়োগ আসা না আসার ওপর অনেকাংশে প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া রিজার্ভের পজিটিভ টার্নিংয়ে বাড়াতে হবে প্রবাসী আয়। একই সঙ্গে হুন্ডি সিন্ডিকেটকে দ্রæত নিয়ন্ত্রণ করে বৈধভাবে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স আনা নিশ্চিত করতে হবে।

অন্যদিকে রিজার্ভ সংকট কাটাতে দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর বৈদেশিক সংস্থাগুলোর আস্থা ফেরানোর তাগিদ দেন অর্থনীতি-বিষয়ক গবেষকরা। তাদের ভাষ্য, দেশে প্রতিবছরই নতুন ঋণ আসে। কিন্তু এ বছর তেমনটা আসছে না। কারণ, ব্যাংকিং সিস্টেমের ওপর আস্থা কমে যাওয়ায়, সময় মতো পরিশোধ করতে না পারায় বৈদেশিক সংস্থাগুলোর আস্থা সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে তারা নতুন করে ঋণ দিতে চাইছে না। এ ছাড়া মধ্য বা দীর্ঘমেয়াদে যেসব ঋণ নেওয়া হয়ে থাকে, সেখানে নতুন করে ঋণ আসা কমে গেছে। কিন্তু ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে গেছে। যা দেশের রিজার্ভ কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, দেশে সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে ১.৩৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে দেশে এক মাসে সর্বনিম্ন ১.০৯ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল ২০২০ সালের এপ্রিলে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১.৫৪ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমেছে প্রায় ১৩ শতাংশ। দেশের ক্রমহ্রাসমান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মধ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহ এভাবে কমে যাওয়ায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ব্যাংকিং খাত-সংশ্লিষ্টরা অনেকে রিজার্ভের নেগেটিভ টার্নিংয়ের জন্য হুন্ডিতে লাগাম টানতে সরকারের নেওয়া নানা ভুল পদক্ষেপকে দায়ী করেছেন। তারা জানান, অনেক ব্যাংক বিদেশের শাখা থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে থাকে। কিন্তু গত এক বছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রা আসার পরিমাণ কমে গেছে। রপ্তানির জন্য রেট বেঁধে দেওয়ায় অনেক ব্যাংকও বৈদেশিক মুদ্রা কিনতে পারছে না। অর্থাৎ ডলারের জোগান বা সরবরাহ বাড়ছে না, কিন্তু খরচ অব্যাহত রয়েছে। তাই ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভে থাকা ডলার সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে তাদের হাতে থাকা রিজার্ভ প্রতি মাসেই কমছে।

তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে গেছে। এমনকি যে প্রবাসী বাংলাদেশিরা ওয়েজআর্নার্স বন্ডে বিনিয়োগ করতেন, অনেকে তা ভেঙে ফেলছেন। এ ছাড়া ডলারের বিনিময় রেট বেড়ে যাওয়ার কারণে অনেক স্বল্পমেয়াদি ঋণ আগেই পরিশোধ করে দেওয়া হচ্ছে। এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে নেতিবাচক প্রবণতা তৈরি হয়েছে।

যদিও অর্থনীতিবিদরা অনেকে এসব বিষয়গুলোকে ‘খোঁড়া যুক্তি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক কারণে রিজার্ভের প্রকৃত হিসাব নিয়ে নানা লুকোচুরি চলছে। যা সংকট আরও বাড়াচ্ছে।

শ্রীলংকার অর্থনীতির ভেঙে পড়াকে উদাহরণ হিসেবে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, প্রথমেই রিজার্ভ সংকট স্বীকার করা জরুরি। এটা মানতে হবে, এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা কাজ করেনি। এটা স্বীকার করতে হবে, না হলে সংশোধন করা যাবে না। এরপর বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে বাজারভিত্তিক করা, ব্যাংকিং খাতের আস্থাহীনতার সংকট কাটানো, সুদের হার শিথিল করে দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ভুল স্বীকার করে সেই অনুযায়ী সংশোধনের ব্যবস্থা নেওয়া হলে পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা মুশকিল- যোগ করেন জাহিদ হোসেন।

এদিকে রিজার্ভ সংকট কাটাতে বিদেশি ঋণের অর্থছাড়ে গুরুত্ব দেওয়ার তাগিদ দেন অর্থনীতিবিদরা। তারা জানান, নানা দুর্বলতার কারণে গত অর্থবছর অর্থছাড় কম হয়েছে। অর্থছাড়ের বিষয়টি নির্ভর করছে বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতার ওপর। এই মুহ‚র্তে সরকারি ঋণের প্রকল্পে আমলাদের মনোযোগ বেশি থাকবে, কারণ বিদেশি ঋণের প্রকল্পে নয়-ছয় করা কঠিন।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, নির্বাচনের প্রভাবটা তখন পড়বে যদি সরকারি কর্মকর্তাদের মনোযোগ অন্যদিকে চলে যায়। বিদেশি ঋণের প্রকল্পগুলো থেকে অর্থছাড় পেতে হলে দুই দিকেই সমান নিয়ম মানতে হয়। প্রথমত, সরকারের নিয়ম, দ্বিতীয়ত যার কাছ থেকে ঋণ নেওয়া হয়, তাদের নিয়ম। ফলে সরকারি অর্থায়নের প্রকল্প থেকে যেভাবে সহজে এদিক-সেদিক করা যায়, প্রকল্প ঋণের অর্থ থেকে সহজে তা করা যায় না। সেদিক থেকে নির্বাচনের একটা প্রভাব থাকতে পারে।

এদিকে রিজার্ভের পজিটিভ টার্নিং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমদানি বা রপ্তানির নামে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ক্ষেত্রে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন অর্থনীতি বিষয়ক গবেষকরা।

অর্থ পাচার নিয়ে কাজ করেন, এমন সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে টাকা বেরিয়ে যায় দুইভাবে- একটি উপায় হচ্ছে, পণ্য আমদানির সময় কাগজপত্রে বেশি দাম উল্লেখ করে টাকা পাচার, আরেকটি হচ্ছে, পণ্য রপ্তানি করার সময় কাগজপত্রে দাম কম দেখানো। এমনকি অনেক সময় খালি কন্টেইনার যাওয়া আসা করেছে, এমন ঘটনাও ঘটেছে।

তবে শুল্ক গোয়েন্দারা বলছেন, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে তারা অভিনব পন্থা রয়েছে। সেটা হলো, ক্রেতাদের কাছে নমুনা হিসাবে পণ্য পাঠানোর কথা বলা হলেও আসলে তার মাধ্যমে টন টন পণ্য পাঠানো হয়েছে, যার কোনো মূল্য দেশে আসেনি।

বছরে বাংলাদেশ থেকে আশি হাজার কোটি টাকা পাচার হয় বলে বলছে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা গেøাবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই)। তাদের ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়, টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। গত সাত বছরে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে। 

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মানীয় ফেলো ডক্টর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাণিজ্যের নামে যে দেশ থেকে অর্থ পাচার করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে সরকারকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। এটা অনেক পুরনো অভিযোগ, সবাই জানে। এটা শনাক্ত করা খুব কঠিন কিছু না। কিন্তু কখনো এসব ক্ষেত্রে কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। ব্যবস্থা নেওয়া হলে হয়তো আমদানি-রপ্তানির নামে বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের বিষয়টি এত প্রকট হয়ে উঠতে পারত না।

এদিকে রপ্তানির নামে অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক খাত সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট অভিযোগ করেছেন। তাদের ভাষ্য, এই খাতের পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে সাধারণত প্রাধান্য দিয়ে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ফলে এসব খাতের রপ্তানি পণ্যে দ্রুত ছাড় দেওয়া হয়, কড়কড়িও কম করা হয়। এরই সুযোগ নিয়েছে এই অপরাধী চক্রটি। এই চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে রপ্তানির নামে বিদেশে অর্থ পাচার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তারা।

যাযাদি/ এস