চট্টগ্রাম বন্দর এনসিটি পরিচালনা নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে
প্রকাশ | ২১ মে ২০২৫, ১২:১৩

চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) পরিচালনা নিয়ে বিতর্ক এখন তুঙ্গে। বিষয়টি চট্টগ্রাম থেকে এখন টক অব দ্য কান্ট্রিতে পরিণত হয়েছে। দেশি না বিদেশি অপারেটর নিয়োগ হবে তা নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত।
চট্টগ্রামে রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যেও এনসিটি পরিচালনা নিয়ে চলছে নানা বিতর্ক। কেউ পক্ষে বলছেন, আবার কেউ বিদেশি অপারেটরের পরিচালনার বিরোধিতা করছেন।
শনিবার ১৭ মে ঢাকায় জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বন্দর টার্মিনাল নিয়ে মন্তব্য করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার টার্মিনাল বিদেশি কোম্পানির হাতে দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। বিষয়টি নিয়ে উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যে রোববার চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের গেটেই ব্যানার টাঙিয়ে অবস্থান ধর্মঘট পালন করা হয়। বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে ‘চট্টগ্রাম সুরক্ষা কমিটি’ নামের একটি সংগঠন এই কর্মসূচি পালন করে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বন্দর ভবনের সামনে তিন ঘণ্টা ধরে চলে অবস্থান কর্মসূচি।
এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব ওমর ফারুক বলেন, এনসিটির পুরোনো অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড টার্মিনালটি পরিচালনা করেছিল। তিন বছর আগে তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর টেন্ডার আহ্বান করা হয় এনসিটি পরিচালনার জন্য। কিন্তু টেন্ডার প্রক্রিয়া এখনও সম্পন্ন হয়নি। নতুনভাবে জিটুজি ভিত্তিতে অপারেটর নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা এখনও প্রক্রিয়াধীন। কারা বা কে এনসিটি পরিচালনা করবে তা চূড়ান্ত করতে আরও সময় লাগতে পারে।
বিষয়টি জানতে বর্তমান অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার
রুহুল আমিনকে কয়েকবার ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি।
বন্দর সূত্রে জানা যায়, ২০০১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের আমলে চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল নির্মাণ শুরু হয়। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে এই টার্মিনাল নির্মাণ করে। ১ হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের ও ২৬ হেক্টর জায়গায় ব্যাকআপ ফ্যাসিলিটিজ আছে টার্মিনালে।
নির্মাণ শেষে কনটেইনার হ্যান্ডেলের জন্য টার্মিনাল ২০০৭ সালে পুরোদমে অপারেশনাল কাজে যুক্ত করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটিতে বছরে ১০ লাখ কনটেইনার ওঠানো-নামানোর সক্ষমতা আছে। ২০২৪ সালে ১২ লাখ ৮১ হাজার হ্যান্ডলিং হয় যা হ্যান্ডেল সক্ষমতার চেয়ে বেশি। বন্দরের চারটি টার্মিনালের মধ্যে এনসিটিতে এককভাবে ৪৪ শতাংশ কনটেইনার ওঠা-নামা করা হয়। এই টার্মিনালে বিশ্বমানের ১২টি ক্রেনের স্থলে আছে ১৪টি।
আর কনটেইনার স্থানান্তরের জন্য পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট আছে। কথিত আছে নিয়োগের পর বিদেশি অপারেটর ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। জনবল এবং পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট থাকা সত্ত্বেও বিদেশি অপারেটর নিয়োগ হলে ওই পরিমাণ অর্থ এনসিটিতে কীভাবে ব্যয় হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
বিতর্কের সূত্রপাত : আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিদেশি অপারেটরের হাতে এনসিটি পরিচালনার ভার দেওয়ার তৎপরতা শুরু হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আবার বিদেশি অপারেটরের হাতে পরিচালনার দায়িত্ব যাচ্ছে বলে গুঞ্জন ওঠে।
এরই মধ্যে আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ড নামে প্রতিষ্ঠানকে এনসিটি পরিচালনার ভার দেওয়ার সংবাদ প্রকাশ হয়ে পড়ে।
ডিপি ওয়ার্ল্ডকে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে জিটুজি ভিত্তিতে টার্মিনালটি পরিচালনার ভার দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই অপারেটর বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম টার্মিনাল অপারেটর।
এরপর থেকে চলছে নানা বিতর্ক। কেউ বলছেন বিদেশিদের হাতে এনসিটি পরিচালনা ছেড়ে দেওয়ার দরকার নেই। কেউ বলছেন এনসিটি পরিচালনা ছেড়ে দেওয়া হলে বন্দর ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে এনসিটির পরিচালনা উন্নত হবে। বেশিরভাগই মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগ আমলের ধারাবাহিকতা অনুসরণ করে বিদেশিদের হাতে পরিচালনা ছেড়ে দিচ্ছে।
২০২৩ সালের মার্চে এনসিটি সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের আওতায় পরিচালনার জন্য অর্থনৈতিক বিষয়-সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছিল। প্রকল্পের জন্য ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ করা হয় ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স করপোরেশনকে (আইএফসি)। গত বছরের ৫ নভেম্বর পিপিপি কর্তৃপক্ষ, আইএফসি ও বন্দর কর্তৃপক্ষের যৌথ সভায় প্রকল্পের টাইমলাইন ঠিক করা হয়। এর মধ্যে আইএফসি এ প্রকল্পের ট্রানজেকশন স্ট্রাকচারিং রিপোর্ট বা টিএসআর প্রদান করার কথা।
এই প্রতিবেদন অনুমোদনের পর ডিপি ওয়ার্ল্ডকে আরএফপি (রিকুয়েস্ট ফর প্রপোজাল) দেওয়া হবে। আগামী নভেম্বরে এ ব্যাপারে একটি চুক্তি হওয়ার কথা। চুক্তি হলে টার্মিনালটি পুরোপুরি ডিপি ওয়ার্ল্ডের হাতে চলে যাবে। তারা মাশুল আদায়, লোকবল নিয়োগ থেকে বন্দরকে এককালীন, বার্ষিক ও কনটেইনারপ্রতি অর্থও প্রদান করবে।
রাজনৈতিক দলের মতামত : জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বিদেশিদের পরিবর্তে দেশীয় অপারেটরের মাধ্যমে এনসিটি পরিচালনার মতামত জানানো হয়েছে। গত (২০ এপ্রিল) চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে দেশীয় অপারেটরের মাধ্যমে এনসিটি পরিচালনার দাবি জানানো হয়। শনিবার সংগঠনের পক্ষ থেকে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে একই মতামত ব্যক্ত করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে নগর আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেছিলেন, আমরা বিদেশি বিনিয়োগ চাই। কিন্তু সেই বিদেশি বিনিয়োগ হবে গ্রিন ফিল্ডে। আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে তৈরি করা এনসিটি কেন বিদেশিদের দেওয়া হবে বোধগম্য নয়।
গত ১০ মে সিপিবির পক্ষ থেকে সংবাদপত্রে পাঠানো বিবৃতিতে এনসিটি বিদেশিদের মাধ্যমে পরিচালনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো হয়। বিবৃতিতে দলের সভাপতি মো. শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগমুহূর্তে এনসিটি পরিচালনার ভার বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় তারা সেটি করতে পারেনি। এখন অন্তর্বর্তী সরকারও এনসিটি বিদেশিদের হাতে দেওয়ার জোর চক্রান্ত শুরু করেছে।
গত ১৫ মে ঢাকার সেগুনবাগিচায় দলের অফিসে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির রাজনৈতিক পরিষদের সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশি কোনো কোম্পানিকে লিজ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী ও অদূরদর্শী।
বন্দর ভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট : এবার বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে ইজারা দেওয়ার প্রক্রিয়ার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে চট্টগ্রাম সুরক্ষা কমিটি নামে একটি সংগঠন। রোববার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত বন্দর ভবনের সামনে এ কর্মসূচি পালন করা হয়। সমাবেশে বক্তারা বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে আওয়ামী লীগের আমলের সব সিন্ডিকেট ভাঙতে সবাইকে এক হতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগের বিরুদ্ধে নই আমরা। তবে এনসিটির পরিচালনার সক্ষমতা আমাদের আছে। পরিচালনার ভার বিদেশিদের কাছে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
বন্দর ব্যবহারকারীদের অভিমত : বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরোয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম সুজন বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ ইতিবাচক। বড় কোনো কাজের জন্য বড় বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে এনসিটি পরিচালনার মতো ছোট বিনিয়োগে বিদেশি অপারেটর প্রয়োজন আছে কি না প্রশ্ন আছে। আমরা মনে করছি দক্ষ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এনসিটি পরিচালনা করা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে চট্টগ্রাম বন্দরের এক শিপ হ্যান্ডলিং অপারেটর বলেন, বন্দরে বিদেশি বিনিয়োগ দরকার হলেও এনসিটিতে দরকার নেই। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে এনসিটিকে কেন টার্গেট করা হয়েছে বুঝলাম না। নতুন একটি বন্দর স্থাপনে যদি বিনিয়োগ আহ্বান করা হতো অনেক ভালো হতো।
তবে ভিন্নমত পোষণ করেছেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ। তিনি বলেন, ডিপি ওয়ার্ল্ড প্রতিবেশী ভারতেও অনেক বন্দর পরিচালনা করছে।
একটি দক্ষ প্রতিষ্ঠান এবং আমাদের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশেরই প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান এনসিটি পরিচালনা করলে দক্ষভাবেই পরিচালনা হবে। তারা এনসিটি পরিচালনা করলে দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে এমন কোনো আশঙ্কা নেই।