সম্পত্তি নিবন্ধন ফি ও করহার ৪০ শতাংশ কমাবে সরকার
প্রকাশ | ২১ মে ২০২৫, ১২:১৯

আগামী অর্থবছর থেকে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি ও করহার প্রায় ৪০ শতাংশ কমাবে সরকার। এই বড় কর্তনের পাশাপাশি মৌজা মূল্য থেকে সরে এসে বাজারমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এসব সম্পত্তির দলিল মূল্য নির্ধারণ করা হবে। কৌশলী এই পদক্ষেপ—আবাসনখাতে কালো টাকার অপ্রতিরোধ্য দাপট কমিয়ে— সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর লক্ষ্যে নেওয়া হচ্ছে।
বর্তমানে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে অঞ্চলভেদে প্রায় ১৪ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ হারে বিভিন্ন ধরণের কর ও ফি রয়েছে। আগামী অর্থবছর এটি কমিয়ে ৮ শতাংশ থেকে ৯ শতাংশে নামিয়ে আনা হতে পারে।
সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যা ক্রেতা-বিক্রেতাকে বড় ধরণের কর ছাড় দেওয়ার পরও— আবাসন খাতে স্বচ্ছতা ও রাজস্ব আহরণ বাড়াবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সভায় আইন মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
জমির আনুষ্ঠানিক রেকর্ডের সবচেয়ে ছোট ইউনিট হচ্ছে মৌজা। নিবন্ধিত মূল্যকে বিবেচনায় নিয়ে জমির মৌজা মূল্য নির্ধারণ করে সরকার। প্রায় সকল দলিল মৌজা মূল্যে নিবন্ধিত হয়, যা সাধারণত প্রকৃত বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক কম হয়। জমি ও ফ্ল্যাটের মৌজা মূল্য বাজার মূল্যের তুলনায় অনেক কম হওয়ায় বর্তমানে, বেশিরভাগ ক্রেতা-বিক্রেতা বেশি দামে জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচা করলেও— রাজস্ব ফাঁকি দেওয়ার জন্য মৌজা মূল্য অনুযায়ী কম দাম দেখিয়ে দলিল করে। দলিল মূল্যের অতিরিক্ত টাকা ব্যাংকিং চ্যানেলের বাইরে লেনদেন করে, যা মূলত কালো টাকা বা অপ্রদর্শিত অর্থ। এতে বিপুল রাজস্ব বঞ্চিত হয় সরকার।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জমি ও ফ্ল্যাট রেজিস্ট্রেশন ফি ও কর বাবদ সরকারের মোট রাজস্ব আদায় হয়েছে ১২ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে উৎসে কর বা গেইন ট্যাক্স থেকে, যার পরিমাণ ৬ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা এবং স্থানীয় সরকার কর বাবদ ৩ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা। এছাড়া, রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ ১ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা রাজস্ব পেয়েছে সরকার। বেসরকারি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের তথ্যমতে, বাজারমূল্যের তুলনায় কম দাম দেখিয়ে রেজিস্ট্রেশন হওয়ায়— প্রতিবছর সরকার প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারায়।
তাই সরকার এ সমস্যার সমাধানে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এনবিআর কর্মকর্তাদের মতে, প্রস্তাবিত কর কমানো সত্ত্বেও যদি সম্পত্তি প্রকৃত বাজারমূল্যে নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা যায়, তাহলে মোট রাজস্ব আয় বরং বাড়বে।
এ প্রসঙ্গে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আগামী অর্থবছরের বাজেটে আবাসন খাত বা অন্য কোনখাতের জন্যই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, "আমরা বরং চেষ্টা করছি, জমির মৌজা মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে করহার কমাতে। যেমন ধরুন গুলশানে জমির মৌজা মূল্য ১৫ লাখ টাকা কাঠা। অথচ সেখানে এক কাঠা জমির প্রকৃত দাম ৫ কোটি টাকা। এই ব্যবধানের ফলে যিনি বিক্রি করেন, তিনিও এখন কালো টাকার মালিক হয়ে যান। তাদের অনেকে বিপদে পড়েছেন। এটা বন্ধ করতে আমি ল্যান্ডের দাম বাড়িয়ে ট্যাক্স কমিয়ে দেব। এই কেনাবেচায় লেনদেন করা টাকা অবশ্যই সাদা হবে, সরকারও প্রায় সমপরিমাণ রাজস্ব পাবে।''
সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনীতিবিদ ও এনবিআরের সাবেক কর্মকর্তারা এ উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন। তারা বলেছেন, এটি নিশ্চিত করা গেলে সরকারের রাজস্ব আহরণ বাড়ার পাশাপাশি জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচায় যে ব্ল্যাক মার্কেট গড়ে উঠেছে তা বন্ধ হবে। এতে সাময়িকভাবে জমি ও ফ্ল্যাট কেনাবেচায় কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে কালো টাকার জেনারেশন কমবে এবং আবাসনখাতে স্বচ্ছতা ফিরে আসবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশ এর চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ বলেন, সরকারের এ উদ্যোগ খুবই প্রশংসিত হবে। এখন দলিল মূল্য ও বাজার মূল্যের মধ্যে বড় ধরণের পার্থক্য থাকে, যা কালো টাকা লেনদেনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। কালো টাকার দৌরাত্ম্যের কারণে অনেক ক্ষেত্রে এতে জমি ও ফ্ল্যাটের দামও বেড়ে যায়। তাই সরকারের সিদ্ধান্ত কার্যকর করা গেলে জমি ও ফ্ল্যাটের মার্কেট প্রাইসও রেশনালাইজ হবে।
তিনি বলেন, বাজারমূল্যে রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিত করা গেলে সঠিকভাবে প্রপার্টি ডেটা, প্রাইসিংয়ের তথ্য পাওয়া যাবে, তা এ মার্কেট সম্পর্কে স্পেকুলেশন করতে সহায়তা করবে। আবাসনখাতে কালো টাকা বিনিয়োগের পথ বন্ধ হলে ঘুষ-দুর্নীতিও কমবে।
তবে তিনি সতর্ক করেন, ''এই নীতি বাস্তবায়নের শুরুতে আবাসন ব্যবসায় কিছুটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। কারণ, ক্রেতাকে ট্যাক্সপেইড মানি (কর পরিশোধপূর্বক অর্থ) দিয়ে পুরো মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এতে ক্রেতার সংখ্যা কমে যাবে। কিন্তু, দীর্ঘমেয়াদে এটা দুর্নীতিকে নিরুৎসাহিত করবে এবং আবাসনখাতে ট্রান্সপারেন্ট নিশ্চিত হলে খাতটি ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।"
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আবদুল মজিদ , এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু কর কমিয়ে যদি বাজারমূল্যে দলিল করতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের বাধ্য করা না যায়, তাহলে সরকারের রাজস্ব আহরণ কমবে।
এদিকে রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) নিবন্ধন খরচ কমানোর প্রস্তাবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখলেও— মৌজা মূল্যকে বাজারমূল্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে।
আবাসনখাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন- রিয়েল এস্টেট এন্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) এর সিনিয়র সহ-সভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর ও ফি কমানোর উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, "আমরা দীর্ঘদিন ধরে রেজিস্ট্রেশন কস্ট ৯ শতাংশের মধ্যে নামিয়ে আনার দাবি করে আসছিলাম। সরকার এ হার কমালে তা ইতিবাচক হবে।"
তবে মৌজা মূল্য বাড়িয়ে বাজারমূল্যে দলিল করার বিধান চালুর বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে তিনি বলেন, "এটি করা ঠিক হবে না। আর বিষয়টি সম্পর্কে আমরা যেহেতু কিছু জানি না, তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে না।"
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ বলেন, অতীতে বিভিন্ন সময় আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে করহার কমানো হলেও— কর ফাঁকির ক্ষেত্রে তাদের আচরণ আগের মতোই রয়ে গেছে।
এসব ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ টাকা নিয়েও ক্রেতাদের কেনা জমি ও ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন তাঁদের নামে দিচ্ছে না। তাই সরকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে যেন তারা কঠোরভাবে বাজারমূল্যে দলিল করতে বাধ্য করতে পারে"- তিনি যোগ করেন।