চট্টগ্রাম বন্দরে ১০০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাব
প্রকাশ | ১৫ জুন ২০২৫, ১৬:৫৭

দেশব্যাপী মূল্যস্ফীতি যখন সাধারণ মানুষের বাজেটকে চাপের মধ্যে রাখছে , তখন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে শুল্ক ৭০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। এ পদক্ষেপ দেশের অর্থনীতিতে নতুন করে চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
গত ২ জুন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বহুল প্রতীক্ষিত এই শুল্ক পুনর্নির্ধারণ বিষয়ে আলোচনা হয়। বৈঠকে নৌপরিবহন উপদেষ্টা জুন মাসের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার তাগিদ দেন। বন্দরের কর্মকর্তারা জানান, জুনের শেষদিকে চূড়ান্ত বৈঠনের আগেই অংশীজনদের কাছ থেকে লিখিত মতামত চাওয়া হয়েছে।
যদিও শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়টি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে, তারপরও সম্ভাব্য বৃদ্ধির মাত্রা—আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও অর্থনীতিবিদদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। তারা সতর্ক করে বলছেন, এতে খাদ্যপণ্য থেকে শুরু করে উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়তে পারে, যা ভোক্তাদের আরও চাপের সম্মুখীন করবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের চীফ পারসোনেল অফিসার ও মুখপাত্র নাসির উদ্দিন এই প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন জানিয়ে বলেন, "১৯৮৬ সালের পর থেকে শুল্ক হালনাগাদ হয়নি। এই বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিচালন ব্যয় মেটানো ও সেবা উন্নয়নের খরচ বহন করা সম্ভব হবে।"
শুল্কের এই সংশোধন প্রক্রিয়ায় প্রায় ৫০টি সেবাকে প্রভাবিত করবে। এর মধ্যে রয়েছে বন্দর কর, বার্থিং ফি, ফর্কলিফ্ট চার্জ ও অন্যান্য ইউটিলিটি খরচ। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে এ পাঁচটি সেবার সামান্য পরিবর্তন হলেও বাকি সব শুল্ক তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অপরিবর্তিত রয়েছে।
যেমন ২০ ফুটের একটি স্ট্যান্ডার্ড কনটেইনার (টিইইউ) হ্যান্ডলিংয়ে বর্তমানে আমদানিকারকের খরচ পড়ে প্রায় ১৫ হাজার টাকা (বা ১২৩ ডলার)। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে এই খরচ বেড়ে ২৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
যদিও বন্দর কর্মকর্তাদের দাবি, চট্টগ্রামের বর্তমান হ্যান্ডলিং চার্জ এখনো আঞ্চলিক অন্যান্য বন্দরের তুলনায় অনেক কম—যেমন কলম্বোতে এক টিইইউ এর আনলোডিং চার্জ ১০০ ডলার, সিঙ্গাপুরে ৭৫ ডলার, আর চট্টগ্রামে মাত্র ৪৩.৪০ ডলার।
২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের আয় দাঁড়ায় ৫,০৫৫ কোটি টাকা (৪৩০ মিলিয়ন ডলার), যা ২০২৩ সালের তুলনায় ২১ শতাংশ বেশি। একই বছরে উদ্বৃত্ত ৩৭ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ২,৯৪৮ কোটি টাকায় (২৫০ মিলিয়ন ডলার)। রাজস্বের এই জোরালো প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্তৃপক্ষ পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাওয়াকেই শুল্ক বৃদ্ধির পেছনে যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে।
তবে ব্যবসায়ীদের মতে, শুল্ক বাড়ানোর পক্ষে এটা উপযুক্ত সময় নয়। বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কাইয়ুম খান বলেন, "১৫% হারে একটি সীমিত পরিসরের বাড়তি শুল্ক গ্রহণযোগ্য হতে পারে।"
তিনি সতর্ক করে বলেন, "ব্যবসায়িক খাত ইতোমধ্যে মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বাড়তি পরিবহন খরচ ও চাহিদার দুর্বলতা সামলাচ্ছে। এ অবস্থায় এত বড় মাত্রায় শুল্ক বাড়ানো হলে তা অনেক প্রতিষ্ঠানকে ঝুঁকিতে ফেলবে।"
এদিকে এমন প্রস্তাবে আমদানিকারক-রপ্তানিকারকদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। আমদানিকারকরা বলছেন, প্রস্তাবিত শুল্ক বৃদ্ধি তাদের বিদ্যমান সমস্যাকে আরও গভীর করবে। আমদানিকারক ও রাশেদ ব্রাদার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আক্তার হোসেন জানান, "মাত্র মার্চেই বন্দরের স্টোরেজ ভাড়া চারগুণ বেড়েছে। কাস্টমস জটিলতায় কনটেইনার প্রায়ই ১০ থেকে ১৫ দিন পড়ে থাকে, যেখানে ফ্রি উইন্ডো মাত্র চারদিন। এতে দৈনিক প্রতি কনটেইনারে ৪৮ ডলার খরচ হয়, যা আমাদের মুনাফার মার্জিনে বড় চাপ তৈরি করছে।" তিনি আরও বলেন, "যদি শুল্ক দ্বিগুণ হয়, তার ভার ভোক্তাদেরই বহন করতে হবে—আমাদের পক্ষে আর খরচ সামলানো সম্ভব নয়।"
রপ্তানিকারকরা, বিশেষত তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা এতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন। বাংলাদেশের মোট রপ্তানিতে ৮০ শতাংশেরও বেশি অবদান এই খাতের। বিজিএমইএ'র সাবেক একজন পরিচালক বেলায়েত হোসেন বলেন, "ধাপে ধাপে ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে শুল্ক বাড়ানো যেতে পারে। এর বেশি হলে কাঁচামাল আমদানিও ব্যয়বহুল হবে, আবার পণ্যের দাম বাড়ায় রপ্তানি বাজারেও বিপদ তৈরি হবে।"