চাইলেই বিশ্বজুড়ে গাড়ির কারখানা বন্ধ করতে পারে চীন!

প্রকাশ | ০১ জুলাই ২০২৫, ১৬:২৫

যাযাদি ডেস্ক
আধুনিক উৎপাদন লাইনে অটোমোবাইল শিল্প এখন ব্যাপকভাবে শিল্প রোবটের ওপর নির্ভরশীল। এসব রোবটের যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিক্স তৈরিতেও অপরিহার্য বিরল খনিজ উপাদানগুলো। ছবি: সংগৃহীত

 

 


রেয়ার আর্থ বা বিরল খনিজের মধ্যে আছে ১৭ ধরনের মৌলিক উপাদান, যা আধুনিক প্রযুক্তির প্রায় সব ক্ষেত্রেই অপরিহার্য।

গত ৪ এপ্রিল, চীন তাদের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে দুর্লভ বা বিরল খনিজ, যা বিশ্বব্যাপী গাড়ি শিল্পে ব্যাপক আতঙ্ক তৈরি করেছে।

এই নিষেধাজ্ঞার পর বিরল খনিজের জন্য চীন নির্ভরতার খেসারত দিচ্ছে বৈশ্বিক গাড়ি শিল্প। এমনটাই মনে করছেন পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা।

রেয়ার আর্থ বা বিরল খনিজের মধ্যে আছে ১৭ ধরনের মৌলিক উপাদান, যা আধুনিক প্রযুক্তির প্রায় সব ক্ষেত্রেই অপরিহার্য — যুদ্ধবিমান, সাবমেরিন, স্মার্টফোন, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, এমনকি টেনিস র‍্যাকেট বা বেসবল ব্যাটেও এগুলোর ব্যবহার রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই, আধুনিক যানবাহনেও এই উপাদানগুলোর ব্যবহার অপরিহার্য।

গাড়ির দূষণ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত ক্যাটালিটিক কনভার্টার থেকে শুরু করে ইলেকট্রিক ভেহিকেলের মোটর ও ব্যাটারি তৈরিতেও দুর্লভ খনিজ উপাদানগুলো অপরিহার্য।

'বিরল খনিজ শুধু ইভি বা ইলেকট্রিক গাড়ির জন্যই নয়, বরং গাড়ির সিটবেল্ট, স্টিয়ারিং হুইল, এবং বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশসহ নানা অংশে ব্যবহার হয়," বলছেন সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ক্রিটিক্যাল মিনারেলস সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক গ্রেসলিন বাসকারান। তাঁর মতে, "বিরল এসব খনিজ ছাড়া বর্তমান যুগের গাড়ি তৈরি করা প্রায় অসম্ভব।"

এসব খনিজ পদার্থকে সাধারণত তাদের আণবিক ওজন অনুযায়ী ভাগ করা হয়। লাইট রেয়ার আর্থ তুলনামূলকভাবে সহজলভ্য, কিন্তু মিডিয়াম ও হেভি রেয়ার আর্থে পুরোপুরি চীনের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

বিশ্বের প্রায় ৭০ শতাংশ রেয়ার আর্থ খনি নিয়ন্ত্রণ করে চীন। তবে চীনের প্রকৃত আধিপত্য রয়েছে এই খনিজের প্রক্রিয়াকরণে। বিশ্বে মোট বিরল খনিজ প্রক্রিয়াকরণের প্রায় ৯০ শতাংশ এবং হেভি রেয়ার আর্থের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বেইজিংয়ের।

বাস্তবতা হলো, 'বিরল' শব্দটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর। প্রকৃতিতে এগুলো খুব একটা দুর্লভ নয়, বরং এগুলোকে শিলার ভেতর থেকে আলাদা করা এবং বিভিন্ন উপাদানকে আলাদা করার জটিল ও ব্যয়বহুল প্রক্রিয়াই এগুলোকে 'বিরল' করে তোলে।
২০২৩ সাল থেকেই চীন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খনিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরও কঠোর করছে বলে জানান বাসকারান। তবুও এবারের ৪ এপ্রিলের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা বিশ্ব গাড়ি শিল্পকে হতবাক করে দিয়েছে।

"এটা যেন আকাশ থেকে পড়লো," বলেন আলিক্সপার্টনার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড্যান হার্স। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে বৈশ্বিক গাড়ি প্রস্তুতকারকরা অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে পড়েন। যা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন,  "প্রায় কোনো প্রস্তুতির সুযোগই ছিল না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমদানি পাইপলাইনের সব খনিজ শেষ হয়ে যায়।"

একারণে ইউরোপের কিছু গাড়ি নির্মাতা কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। ফোর্ড কোম্পানিকেও তাদের জনপ্রিয় এক্সপ্লোরার এসইউভির উৎপাদন সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে হয়েছে।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে চীন কিছু গাড়ি নির্মাতার জন্য আংশিকভাবে বিরল খনিজ উপাদান সংগ্রহের সুযোগ দিয়েছে। অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন দাবি করেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রে বিরল খনিজ ও শিল্প চুম্বক দ্রুত সরবরাহের জন্য চীনের সঙ্গে একটি চুক্তিতে পৌঁছেছে।

তবে এসব উদ্যোগ কতটা স্থায়ী হবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।

"অবস্থা এখনো স্বাভাবিক হয়নি," বলেন বাসকারান। "মার্কিন-চীন সম্পর্কের মধ্যে ট্যারিফ ও খনিজ নিষেধাজ্ঞা ঘিরে অনেক অনিশ্চয়তা রয়েছে। গত দুই বছর ধরে চীন তাদের নিষেধাজ্ঞা বাড়াচ্ছে। বিরল খনিজ এক্ষেত্রে কেবল সর্বশেষ সংযোজন।"

যদিও তিনি মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই সংকটের সমাধান হতে পারে — রিসাইক্লিং, বিকল্প উৎস সন্ধান এবং নতুন উদ্ভাবনের হাত ধরে। এই সংকট হয়তো বিশ্বকে বিরল খনিজ পেতে চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে বাধ্য করবে।

তবে এটা সাম্প্রতিককালের একমাত্র সরবরাহ সংকট নয়। গত কয়েক বছরে বারবার এমন সংকট দেখা গেছে, এবং ড্যান হার্স আশঙ্কা করছেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।

"আজ সেটা রেয়ার আর্থ," বলেন হার্স। "কিন্তু কাল সেটা অন্য কিছু হতে পারে, যার দাম হয়তো খুব বেশি নয়, কিন্তু সেটির গুরুত্ব বা চাহিদা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে, আর তখন বিশ্ব আবার বিপর্যয়ের মুখে পড়বে।"