চৌহালীতে স্কুল-পড়া ভুলে যাচ্ছে চরাঞ্চলের কোমলমতি শিশুরা

প্রকাশ | ২৪ জুন ২০২১, ১৮:১২

রোকনুজ্জামান চৌহালী প্রতিনিধি

স্কুলে তালা। বাড়িতে পড়ানোর কেউ নেই। অনলাইন নাগালের বাইরে। এমনকি অনেকের বাড়িতে টিভি কিংবা বিদ্যুৎ সুবিধাও নেই।

 

এদিকে দারিদ্রপীড়িত চরাঞ্চলে করোনার অভিঘাত আরও নির্মম। অভাব বেড়েছে। অনেক শিশুর দিন কাটছে বাবা-মায়ের সঙ্গে খেত-খামারে কাজ করে কিংবা চরে চরে ছাগল চরিয়ে ও খাঁচায়  পাখিদের নিয়ে । ফলে পড়াশোনার সঙ্গে তৈরি হয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব।এতে করে  বাড়ছে বাল্য বিবাহও  ।

 

করোনার দীর্ঘ ছুটিতে সিরাজগঞ্জের চৌহালী  উপজেলার  মূল ভূখণ্ডের বাইরে দুর্গম চরগুলোতে অবস্থিত প্রায় একশত আটাশটি   প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ২৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর অবস্থা এখন কম-বেশি একইরকম।

 

করোনাভাইরাস মহামারির শুরুর দিকে গত বছরের ১৭ মার্চ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। থমকে যায় শ্রেণীকক্ষে প্রথাগত পাঠদানের বিষয়টি। বিশেষ করে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষা তার চিরায়ত ছন্দ হারিয়ে ফেলে।

 

সর্বশেষ চলতি মাসের ১৩ তারিখ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়ার সরকারি ঘোষণাও বাস্তবায়ন করা হয়নি ।

 

এর মধ্যে, শিক্ষার্থীদের জীবন থেকে হারিয়ে গেছে একটা শিক্ষাবর্ষের পুরোটাই। আরেকটি শিক্ষাবর্ষের অর্ধেকটা চলে যাওয়ার পথে। এই লম্বা সময়ে বিশেষ করে সিরাজগঞ্জের  চৌহালী  উপজেলার   চরাঞ্চলের মতো প্রত্যন্ত এলাকার শিশুদের মনোজগতে বিদ্যায়তনের যে কাঠামো ছিল, তা চলে এসেছে অনেকটা বিলীয়মান অবস্থায়।

 

 

যেমন: সবুজ ও আশিক । তারা দুজনই এখন খাতা-কলমে সিরাজগঞ্জের  চৌহালী   উপজেলার উমারপুর   ইউনিয়নের ছলের চর  একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। করোনা মহামারির কারণে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় পরীক্ষা ছাড়াই দ্বিতীয়    শ্রেণি থেকে তৃতীয়    শ্রেণিতে উঠার জন্য তাদের কোনো ধরনের বেগ পেতে হয়নি। আবার তৃতীয়  শ্রেণিতে ওঠার পর প্রায় ছয় মাস পার হতে চললেও নতুন বইগুলো খুলে দেখা হয়নি এখনো। পরিবার থেকেও পড়াশোনার কোনো চাপ নেই।

 

 

এখন সবুজ ও আশিক  দিন কাটে চরে পাখি ধরিয়ে  । যায়যায়দিন কে  তারা জানায়, নতুন বইগুলো কোথায় রাখা হয়েছে, সেটাও মনে নেই এবং  কোন ক্লাসে  সেটাও ভুলে গেছে ।

 

আবার বাঘুটিয়া   ইউনিয়নে  ঘুশুরিয়া   অবস্থিত একটি বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাথি  ও কামরুল  ইসলামের বক্তব্যও প্রায় একইরকম। কামরুল   বলে, ‘এখনো বই খুলেই দেখিনি। স্কুল বন্ধ। তাই বাবার সঙ্গে সারাদিন মাঠে কাজ করতে হয়। লেখাপড়ার কথা তো ভুলেই গেছি।’

 

এভাবে সাথির    ও দিন কাটে মাঠে মাঠে। মায়ের সঙ্গে ছাগল চরিয়ে ।

 

উপজেলা   প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের  চৌহালী উপজেলার   উমারপুর ২৯ টি বিদ্যালয়  সেখানে  শিক্ষার্থী  সংখ্যা  ১০ হাজার   ও ঘোড়জান   নদীর চরগুলোতে অবস্থিত ১৭ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাত     হাজারের মতো।

 

কথা হয় চৌহালী   উপজেলার এনজিও কর্মী হান্নান  মোরশেদ রতনের  সঙ্গে। তার পর্যবেক্ষণ, মহামারিতে চরাঞ্চলের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোটাই ভেঙে পড়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে কিছুটা পড়ালেখা হলেও প্রাথমিকে একেবারেই নেই।

 

তিনি বলেন, ‘উপজেলা  মূল ভূখণ্ডের শিক্ষার্থীরা প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে পড়ে কিছুটা হলেও পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু চরাঞ্চলে সেটিও নেই। কারণ চরের বাসিন্দাদের আর্থিক সামর্থ্য কম। অভিভাবকরাও অতটা সচেতন না।’

 

চৌহালী  উপজেলা  প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর  ফিরোজের ভাষ্য, মহামারিতে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতিটা হচ্ছে, তা পূরণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে । বর্তমানে  নেপকর্তৃক( N APE)প্রদত্ত  অন্তবর্তী  কালীনপাট টীকা  স্বাস্থ্যবিধি  মেনে  (work  sheet)এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের  বাড়ি-বাড়ি  গিয়ে  শিক্ষকগন পাঠ আদায় করার চেষ্টা  চলছে  ৷

 

তিনি বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদের অনুরোধ করেছি, তারা যেন একটু শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়াশোনার ব্যাপারে খোঁজ-খবর নেন। উপজেলার  মূল ভূখণ্ডের কিছু শিক্ষক আন্তরিকতার সঙ্গে কাজটি করলেও চরগুলোতে তা হচ্ছে না।’

 

চৌহালী উপজেলা সহকারী     প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহজাহান মিয়ার  বক্তব্য, অনলাইন ক্লাসে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের অংশগ্রহণ নেই। কারণ চরগুলোর বেশিরভাগ বাসিন্দাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ। ফলে তাদের অনেকের স্মার্টফোন, এমনকি টিভিও নেই।

 

যায়যায়দিন  কে এই শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এখন সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি। কিন্তু এর মধ্যে যে ক্ষতিটা হয়ে গেছে, তা অপূরণীয়।’ এ বিষয়ে  চৌহালী  উপজেলা  পরিষদের চেয়ারম্যান ও  আ'লীগের  সাধারণ সম্পাদক  মোঃ ফারুক হোসেন সরকার বলেন, বৈশ্বিক মহামারি আমাদের জীবনকে ক্ষতবিক্ষত  করেছে ৷ তেমনি করেছে শিক্ষা  ব্যবস্থা কে ৷

 

যাযাদি/এস