বিভ্রান্তির জালে আটকে যাওয়া শিক্ষাঙ্গন

করোনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক ধরনের কর্মহীন হয়ে বন্দি জীবনযাপন করছে। অনলাইন ক্লাস যে বড় প্রভাব ফেলেছে তা বলা যাবে না। এতে মানসিক স্বাস্থ্যের যথেষ্ট ক্ষতি হচ্ছে। এর বড় রকমের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যাবে সমাজে। বিশ্বের অনেক দেশ এই সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে।

প্রকাশ | ৩০ জুন ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ৩০ জুন ২০২১, ১১:৫৭

এ কে এম শাহনাওয়াজ

করোনাকাল সবার জন্যই ভয়ানক নতুন অভিজ্ঞতা। নীতিনির্ধারণের দায়দায়িত্ব রয়েছে বলে সরকারের ওপর চাপও বেশি। সংক্রমণ কমানো, চিকিৎসাব্যবস্থা, মানুষের জীবন রক্ষা, সার্বিক অর্থনীতিকে সচল রাখা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে সরকারকে ভাবতে হয়। সরকারের প্রাজ্ঞ পরামর্শকরা নানা নীতিনির্ধারণ করছেন। বিভিন্ন আদেশ জারি করছেন। তা কখনো লাগসই হচ্ছে, কখনো ব্যর্থ হচ্ছে। আরো একটি মুশকিল আছে। আমাদের ক্ষমতাবান নীতিনির্ধারকরা নিজেদের মূল্যবান সিদ্ধান্তের বাইরে কখনো যেতে চান না। সংবাদমাধ্যম থেকে যতই পরামর্শ বিশ্লেষণ আসুক সবকিছুই তারা ডাস্টবিনে ফেলে দেন। এসব দিক বিচারে বলা যায়, এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অদূরদর্শী কাঁচা সিদ্ধান্ত এসেছে শিক্ষাঙ্গনসংক্রান্ত নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে। শিক্ষাক্ষেত্র পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মতো নগদ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে না বলে করোনাসংকট মাথায় রেখে দূরদর্শী মেধাবী সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত গৃহীত হলো না। চীনসহ নানা দেশে করোনাকালে সবচেয়ে মনোযোগে নীতিনির্ধারণ করেছে শিক্ষাক্ষেত্রে সংকট কমানোর জন্য। কারণ ওসব দেশের নীতিনির্ধারকরা জানেন একটি দেশের সবচেয়ে জরুরি বিনিয়োগের ক্ষেত্র হচ্ছে শিক্ষা। শিক্ষিত জাতিই প্রকৃত চালিকাশক্তি হবে দেশের। কিন্তু আমাদের দেশের হিসাব আলাদা। এ দেশে দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনায় বিদগ্ধ শিক্ষাবিদদের দেখা যায়নি। তাই নীতিনির্ধারণে একটি হালকা চিন্তারই প্রতিফলন স্পষ্ট হয়েছে বারবার- যা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে। দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্র ও ক্ষমতাবান রাজনীতিকরা যখন সবকিছুর দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে যান, তখন জ্ঞান চর্চার কোনো মূল্য থাকে না। সর্বক্ষেত্রে তারাই জ্ঞান বিতরণ করতে থাকেন। কোভিডকালীন শিক্ষাক্ষেত্রে যে ধরনের নীতিনির্ধারিত হচ্ছে, তাতে মনে হয়, প্রশাসন নিজেদের গা বাঁচাতে যতটা তৎপর, অসংখ্য শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতি ততটা সহানুভূতিশীল নয়। পৃথিবীর অনেক দেশ কোভিডের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে বিপর্যস্ত অবস্থায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে; কিন্তু আমাদের দেশে কার্যত সম্পূর্ণ ব্রাত্য অঞ্চল শিক্ষাক্ষেত্র। বাস্তব অবস্থা বিচারে সরকার সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছে। দফায় দফায় ছুটি বাড়িয়ে দেড় বছর অতিক্রম করে ফেলেছে। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে অনলাইন ক্লাস ও স্কুল শিক্ষার্থীদের জন্য বিটিভিতে ক্লাস নেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এতে দেশের কত ভাগ শিক্ষার্থী বিকল্প শিক্ষায় প্রবেশ করছে তেমন কোনো গবেষণা আছে বলে আমাদের জানা নেই। ভার্চুয়াল মাধ্যমে এই বিকল্প শিক্ষা কার্যকর করতে হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যৎ ও ইন্টারনেট সুবিধা থাকতে হবে। দেশের একটি অংশের শিক্ষার্থীদের যে স্মার্টফোন কেনার সামর্থ্য নেই সে প্রসঙ্গ না হয় বাদই দিলাম। বিদু্যৎ ও ইন্টারনেট সংকটের কারণে প্রতিনিয়ত ক্লাস যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এই সত্যটি আলোচনায় আসছে না। গ্রামগঞ্জ আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের অবস্থা কী আমি জানি না; কিন্তু আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে থেকে বিদ্যুবিভ্রাটের কারণে যেভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছি, তা আমাকে অসহায় করে তুলছে। ভোর থেকে রাত পর্যন্ত কয়েক দফা বিদু্যৎ যাওয়া এখন নৈমিত্তিক ব্যাপার। এই বিদু্যৎ যাওয়াটা লোডশেডিং বলে মনে হয় না। ব্যবস্থাপনার সংকট হয়তো। চার-পাঁচ মিনিট থেকে শুরু করে কখনো আধাঘণ্টা পর্যন্ত বিদু্যৎ থাকে না। প্রায় দিনই ক্লাস চলাকালে হঠাৎ করে চলে যাচ্ছে বিদু্যৎ। আবার বিদু্যৎ থাকলেও হয়তো পাঁচ অঞ্চলে থাকা পাঁচজন ছাত্রছাত্রী জানাল বিদু্যৎ চলে যাওয়ায় ওরা বঞ্চিত হচ্ছে। ইন্টারনেটের জন্য যারা ওয়াই-ফাই ব্যবহার করছে, বিদু্যৎ চলে যাওয়ায় তারা নেট বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর পক্ষে ইন্টারনেটের প্যাকেজ কিনে ক্লাস করা সম্ভব নয়। যখন ধীরে ধীরে স্বাভাবিক করে ফেলা হচ্ছিল জীবনযাত্রা, তখন মনে হচ্ছিল সতর্কতা অবলম্বন করে হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। শত শত পোশাক শিল্পপ্রতিষ্ঠান খুলে গেল। লাখ লাখ শ্রমিক কাজে যোগ দিল। নামকাওয়াস্তে স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহণ চলতে লাগল। অফিস-আদালত খুলে গেল। কাঁচাবাজার থেকে শপিং মল সবই স্বাভাবিক সময়ের মতো চলতে থাকল। শুধু কঠিনভাবে বন্ধ রয়ে গেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অবশ্য বৈশ্বিক মহামারি যে হতাশা তৈরি করেছে, সেখানে ঝুঁকি নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়াটা কঠিন। তার পরও সত্যিটা যা তা হচ্ছে, এই অবস্থার মধ্যেও ভালো কোনো বিকল্প বের করা যেত কিনা। কারণ এর মধ্যে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া ও কার্যকর করা হয়েছে- যা শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ বিবেচনা করে করা হয়নি। হয়তো বিদগ্ধজনরাই করেছেন- যা আমাদের হিসাবের সঙ্গে মিলছে না। যেমন অটো প্রমোশনে ওপরের ক্লাসে উঠিয়ে দেওয়া। এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষা না নিয়ে অদ্ভুত জোড়াতালিতে নম্বর বণ্টন ও উত্তীর্ণের সার্টিফিকেট শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া। করোনাকালে সরকারের সংকট আমরা বুঝি। এমনিতেই দুর্নীতিতে জরাগ্রস্ত স্বাস্থ্য প্রশাসন। হাসপাতালগুলোর অসহায় দশা। অন্যদিকে টিকা জোগাড়েও কঠিন সংকট। এর মধ্যে রাজনৈতিক জগতের ভাগবণ্টনও রয়েছে। তার পরও কোভিডের প্রথম বছর সরকারের পক্ষ থেকে টিকা পাওয়ার যে অগ্রাধিকার ঘোষণা করা হয়, তাতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কোনো স্থান ছিল না। বিধায়কদের দৃষ্টিতে শিক্ষার গুরুত্ব কতটা বোঝা যায়! শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ প্রসঙ্গে সরকারের কাছে কোনো চাহিদা জানিয়েছিল কিনা আমার জানা নেই। অবশ্য এটিও ঠিক, হয়তো অন্যান্য অগ্রাধিকার পাওয়া মানুষের তুলনায় শিক্ষার্থী-শিক্ষকের সংখ্যা অনেক বেশি বলে সরকারিপক্ষ নিবৃত্ত থেকেছে। সুখের কথা, সরকারের দায়িত্বশীল পক্ষ সাম্প্রতিক সময়ে মুখ খুলেছে। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে হয়তো প্রথমবারের মতো কথা বলেছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদান সম্পন্ন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে চায়। এতে আমরা খুব আনন্দ পেয়েছি। তবে টিকা সংগ্রহ নিয়ে যে ধোঁয়াশা চলছে, তাতে থেকে যাচ্ছে আশঙ্কা। এর পরও টিকা যদি পাওয়া যায়, তখন আবার অগ্রাধিকারের তালিকা হলে দেশের 'কম গুরুত্বপূর্ণ' শিক্ষা খাত হয়তো আবার পিছিয়ে পড়বে। তবু সরকারি ঘোষণা শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হতাশা সামান্য কাটাতে পেরেছে বলে আমরা মনে করি। করোনাকালে স্বাস্থ্যসুরক্ষা, সংক্রমণ ঠেকানো ও জীবন রক্ষার চিন্তায়ই হয়তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তালাবদ্ধ রাখা হয়েছে দেড় বছর ধরে। বিকল্প ব্যবস্থাগুলো খুব কার্যকর হচ্ছে না। অন্যদিকে অর্থনৈতিক চালিকাশক্তির বিবেচনায় জীবনের ঝুঁকি মেনেই শুরু থেকে খুলে দিয়েছে পোশাক কারখানাগুলো। লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন সেখানে। অফিস-আদালত খোলা, কাঁচাবাজার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বিপণিবিতান সবই খোলা। এমন কোনো পরিসংখ্যান দেখিনি গার্মেন্টকর্মীরা দলে দলে করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একই কথা। দেড় বছরের অভিজ্ঞতায় আমরা বুঝতে পেরেছি ঘরবন্দি নয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই প্রধান সুরক্ষা। গার্মেন্ট মালিকরা দাবি করেন, তারা কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ব্যবস্থা রেখেছেন তাদের প্রতিষ্ঠানে। ফলে সুফল পাচ্ছেন তারা। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে অতি সংবেদনশীল সরকার শিক্ষা অঞ্চলে কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। তাই যেটুকু সংকট উত্তরণের সুযোগ ছিল তা-ও গ্রহণ করেনি। বিগত এসএসসি পরীক্ষার আগে আমরা অনেকেই বলেছিলাম এখান থেকে-ওখান থেকে নম্বর এনে সার্টিফিকেট দেওয়াটা ঠিক হবে না। একপর্যায়ে এই দুর্ভাগা শিক্ষার্থীদের কাছে এমন সার্টিফিকেট উপদ্রব হয়ে দেখা দিতে পারে। আমরা পরীক্ষা নেওয়ার পথ বাতলে ছিলাম। বলেছিলাম, যে প্রতিষ্ঠানে সিট পড়বে তার আশপাশে প্রাইমারি থেকে নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পাওয়া যাবে। সেগুলো পরীক্ষা কেন্দ্রের আওতায় এনে প্রয়োজনে সেসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সহায়তা নিয়ে সামাজিক দূরত্ব মান্য করিয়ে পরীক্ষা নেওয়া যেত। এখন পোশাক কারখানার বাস্তবতা সামনে রেখে বোঝা যায় এটুকু ঝুঁকি নেওয়া যেত। কিন্তু অধমদের কথা বিশেষজ্ঞরা মানবেন কেন! এসব কারণেই মনে হয়, এ দেশে শিক্ষা বিষয়টি বিধায়কদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ। আসলে এই শিক্ষার্থীরা বড় হয়ে আমলা হলে, তবে তাদের প্রয়োজন ও গুরুত্ব বেড়ে যায়। গাছের শিকড়ের যত্নের প্রয়োজন নেই; সরকারপক্ষের পরিপক্ব ফলটিই দরকার। করোনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এক ধরনের কর্মহীন হয়ে বন্দি জীবনযাপন করছে। অনলাইন ক্লাস যে বড় প্রভাব ফেলেছে তা বলা যাবে না। এতে মানসিক স্বাস্থ্যের যথেষ্ট ক্ষতি হচ্ছে। এর বড় রকমের ক্ষতিকর প্রভাব দেখা যাবে সমাজে। বিশ্বের অনেক দেশ এই সমস্যা নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে। \হশিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে নানা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। আমাদের দেশে সরকারি- বেসরকারি কোনো পক্ষ থেকে এসব নিয়ে ভাবা হচ্ছে এমন তথ্য আমার কাছে নেই। আমরা জানি না, করোনা কবে আমাদের ছেড়ে যাবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আর কতবার সরকারকে বাড়াতে হবে। করোনাকালে দেশে সব কিছু কমবেশি সচল থাকলেও শিক্ষাঙ্গন কবে বন্ধ্যত্ব দশা কাটাতে পারবে, তা বোধ হয় ঈশ্বরই জানেন।