উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে দীর্ঘ ১শ ৬২ ঘন্টা না খেয়ে থাকার পর ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের আশ্বাসে অনশন ভেঙেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনশনকারী শিক্ষার্থীরা।
বুধবার সকালে ১০টা ২০ মিনিটে অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন হকের আশ্বাসে অনশন ভাঙেন।
প্রোভেস্টের পদত্যাগসহ তিন দফা দাবির আন্দোলনে উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগ শিক্ষার্থীদের সম্মিলত আন্দোলন ১৩ দিনে গড়িয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষার্থীদের অনশনের সাতদিন পেরিয়ে অষ্টমে পৌঁছার আগেই ড.জাফর ইকাবাল এসে অনশনকারীদেরকে আশ্বাস দিয়ে অনশন ভাঙান।
বুধবার ভোর ৪টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধান ফটকে পৌঁছান অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল ও তার স্ত্রী ড. ইয়াসমিন হক। এরপর ভোর ৪টা থেকে দেড় ঘন্টা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেন এবং অনশনকারীদের সকল কথা মন দিয়ে শুনেন। এসময় তিনি শিক্ষার্থীদের অনশন ভেঙে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার কথা বলেন। সাথে ড.ইয়াসমিন হোক ও শিক্ষার্থীদেরকে অনেক বোঝান। অবশেষে শিক্ষার্থীরা ড. জাফর ইকবালকে আশ্বাস্ত করেন অনশন ভাঙার কথা। সকলে একযোগে অনশন ভাঙবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। পরে সকাল ১০টা ২০মিনিটে একে একে প্রত্যেককে পানি পান করিয়ে দিয়ে অনশন ভাঙিয়ে দেন ড.জাফর ইকবাল।
এর আগে ভোর ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মীদের উপস্থিতিতে বলেন, শিক্ষার্থীদের ওপর এমন হামলার ঘটনাটি খুবই নিন্দনীয়। এখানে শিক্ষার্থীরা সবাই বাইরে থেকে শীতে কষ্ট করছে। শিক্ষার্থীদের শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ কিন্তু তাদের জন্য কোনো মেডিকেল টিম নেই। যারা তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করতো তাদেরও গ্রেফতার করা হয়েছে। যা খুবই নিন্দনীয় একটি কাজ।
শিক্ষার্থীদের সব অভিযোগ ও দাবি শোনার পর ড. জাফর ইকবাল বলেন, ‘তোমরা আমাকে গণমাধ্যমের সামনে কথা দিয়েছ, এই অনশন ভাঙবে। তোমাদের জীবন অনেক মূল্যবান। একজন মানুষের জন্য তোমরা জীবন দিয়ে দিবা এটা মানা যায় না। সাবেক ৫ শিক্ষার্থীর বিষয়ে কথা হয়েছে। যেহেতু মামলা করা হয়ে গেছে, আদালতে তোলা হবে। তারা কথা দিয়েছেন ছাত্রদের জামিন দেওয়া হ। এ সময় তিনি আর্থিক সহায়তা প্রদান করায় সাবেক শিক্ষার্থী গ্রেফতারের প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদেরকে সাহায্য করতে যদি অ্যারেস্ট হতে হয় তাহলে আমি হব। আমি তোমাদেরকে এই ১০ হাজার টাকা দিলাম। এ টাকা দিয়ে তোমাদের তেমন কিছু হবে না জানি। কিন্তু আমি দেখতে চাই সিআইডি আমাকে অ্যারেস্ট করে কি না।’
শাবি শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পুরো দেশে আলোড়ন তুলেছে উল্লেখ করে জাফর ইকবাল বলেন, ‘তোমরা ইতিহাস গড়েছ। তোমাদের মাধ্যমে যে বার্তা গিয়েছে, তাতে ভবিষ্যতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগের আগে একবার অন্তত ভাবা হবে। তোমাদের সঙ্গে দেশের সব তরুণ আছে।’
তিনি বলেন, ‘আমি ধরে নিয়েছিলাম, অনশনের এখানে মেডিক্যাল টিম আছে। তারা সার্বক্ষণিক দেখভাল করছে। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম, কোনও ডাক্তার নেই। ডাক্তাররা ছিলেন, কিন্তু তাদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আমি এসব ঘটনা বলবো। এখানে অনশনকারীদের অবস্থাই যখন এত খারাপ, তাহলে অসুস্থ ২০ জনের কী অবস্থা! আমি শঙ্কিত। এটা চরম অমানবিকতা। ’
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম সিরাজুন্নেসা চৌধুরী ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে গত ১৩ জানুয়ারি রাতে আন্দোলনে নামেন ওই হলের শিক্ষার্থীরা। এর জেরে পুলিশের লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেডে শিক্ষার্থীসহ ক্যাম্পাসের অন্তত অর্ধশত লোকজন আহত হন। সে ঘটনায় পুলিশ ‘গুলি বর্ষণ ও হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিটের অভিযোগ’এনে অজ্ঞাতপরিচয় ২০০ থেকে ৩০০ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে মামলা করে।
তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেই নির্দেশ উপেক্ষা করে উল্টো উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদের পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে ১৯ জানুয়ারি বিকাল ৩টায় তারা অনশনে যান; ঘোষণা দেন উপাচার্য পদত্যাগ না করা পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার।
শুরুতে মোট ২৪ শিক্ষার্থী অনশনে বসেন। এর মধ্যে নয়জন ছাত্রী এবং ১৫ জন ছাত্র। একজন অনশনকারীর বাবা গুরুতর অসুস্থ হলে তিনি প্রথম দিনই গ্রামের বাড়ি চলে যান। পরে তাদের সঙ্গে আরও পাঁচজন যুক্ত হন।
ড. জাফর ইকবাল সমাচার -
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে জাফর ইকবাল, 'তোমরা ইতোমধ্যে বিজয়ী হয়ে গেছো '
উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমদের পদত্যাগের দাবিতে ২৮শিক্ষার্থীর অনশন ভাঙানোর পর বুধবার সকালে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,
তোমরা কেন তোমাদের জীবন অপচয় করবে? তোমাদের বাঁচতে হবে। তোমরা ইতোমধ্যেই বিজয়ী হয়ে গেছ। সারা দেশের মানুষ তোমাদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে।
ভিসি ফরিদ উদ্দিন একটা দানব!
শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙানোর পর সকাল সোয়া ১১ টায় ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল সাংবাদিক ও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতে বলেন, ভিসি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ একটা দানব। শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থা দেখেও যার মন গলে না, নিজের জায়গায় অনড় থাকেন; আমি তাকে অন্তত মানুষ বলতে পারি না, তিনি দানব।'
শিক্ষার্থীদেরকে আশ্বাস
ড. জাফর ইকবাল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, 'সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে আমাদের নিশ্চিত করা হয়েছে, তোমাদের দাবি মানা হবে। দুটি মামলাই ওঠানো হবে। আর সে কারণেই আমরা এসেছি। নিশ্চিত না হলেও আমরা আসতাম, কিন্তু তোমাদেরকে অনশন ভাঙতে বলতে পারতাম না।'
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সারা বাংলাদেশ নড়েছে
শিক্ষার্থীদেরকে উদ্দেশ্য করে জাফর ইকবাল বলেন, ‘তোমাদের আন্দোলনে ৩৪ জন ভিসির ঘুম নষ্ট হয়ে গেছে। এই ভিসি পদত্যাগ করলে তারাও পদত্যাগ করতে চেয়েছে। আমি ৩৪ জন ভিসির পদত্যাগ দেখতে চাই। তোমরা সারা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নাড়া দিয়েছ।’
মুখরিত ক্যাম্পাস এখন জনশূন্য!
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনশন ভাঙার পর দুপুর একটা থেকে ক্যাম্পাসে কমে গিয়েছে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আনাগেনা।
সরেজমিনে দেখা যায়, সকাল ১০টা ২১ মিনিটে অনশনের পর দুপুর একটা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে থাকে। বিকাল ৩টায় আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের কোনো আনাগোনা বা কোনো কর্মসূচি দেখা যায় নি। ভিসির বাসভবনের সামনে অনশনকারীদের বিছানাপত্র গোছাতে দেখা যায় কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীকে। পুরো ক্যাম্পাসে কয়েকজন সাংবাদিক, আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকজন লোক রয়েছে।
ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থানরত আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী সবুর খান বলেন,রাতে কেউ ঘুমায় নি। শিক্ষার্থীরা সবাই ক্লান্ত, বিশ্রামে গিয়েছে। অনশন ভাঙলেও আন্দোলন চলবে। সন্ধ্যা ৬টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে সবাই জড়ো হবে। সাথে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।"
অনশন ভাঙার পর শিক্ষার্থীদের খবর জনতে চাইলে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থানরত আন্দোলনকারী সবুর খান ও আমিনা জানান, "অনশনরত ছিল ২৮ জন। এর মধ্যে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রাগিব রাবেয়া হাসপাতালে ২৪ জন গিয়েছে চিকিৎসা নিতে। আর বাকী ৪জন বাড়িতে চলে গেছেন। ওরা বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিবেন। "
রাগিব রাবেয়া হাসপাতালে অবস্থানরত স্বেচ্ছাসেবক জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারং বিভাগের শিক্ষার্থী আদিল বিকাল ৩টার দিকে " অনশনে যারা ছিল তাদের মধ্যে হাসপাতালে ৬জনক ভর্তি করা হয়েছে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে আরও ২ থেকে ৩ জনকে ভর্তি করানো লাগতে পারে। "
তিনি বলেন, ভর্তি ৬ জনের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা গুরুতর। তাদের প্রচন্ড জ্বর, খিচুনি আছে। সন্ধ্যার সময়ে বাকীরা চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে নেবে। অনেকে সাময়িক চিকিৎসা করে বাড়িতে গিয়ে চিকিৎসা নেবে বা অন্য কোথাও গিয়ে।
শাবি ক্যাম্পাসে চালু হল 'চাষাভুষা টং'
উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মধ্যেই মঙ্গলবার থেকে ক্যাম্পাসের ফুডকোর্ট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই দিন রাত ৭টা থেকে 'চাষাভুষার টং' নামে এক ভ্রাম্যমাণ দোকান চালু করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একাংশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরের পাশে ফুডকোর্ট এলাকায় এ নতুন টং চালু করেন তারা।
চাষাভুষার টং’ এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন নাম না বলার শর্তে বলেন , "আন্দোলন বন্ধে খাবারের দোকান ও ফুড কোর্ট বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। এ অবস্থায় শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনের খবর সংগ্রহে আসা গণমাধ্যমকর্মীদের খাবার পেতে সমস্যা হচ্ছে। প্রতিবাদ হিসেবে ভ্রাম্যমাণ দোকানটি চালু করা হয়েছে।
যাযাদি/ এস