আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বহাল তবিয়তে, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ

প্রকাশ | ০৪ মে ২০২৫, ১৯:০২

বেরোবি প্রতিনিধি
ছবি: যায়যায়দিন

কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) ইংরেজি বিভাগের ২০১৯-২০২০ সেশনের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ৮ মাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মামলা করার পদক্ষেপ নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। মামলার বাদী ও সাক্ষী প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কয়েক দফা বৈঠকের পর মামলায় আসামীর তালিকা খসড়া প্রস্তুত করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। তবে তালিকায় অনেক হামলাকারীর নাম বাদ পড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন আন্দোলনকারীরা।

মামলার তালিকায় রয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি পোমেল বড়ুয়া, সাধারণ সম্পাদক শামীম মাহাফুজ, সহ-সভাপতি গ্লোরিয়াস (ফজলে রাব্বি), বিধান,আদুল্লাহ আল নোমান খান ও তানভীর, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোমিনুল, সাংগঠনিক সম্পাদক ধনঞ্জয় কুমার টগর ও ফরহাদ হোসেন এলিট, দপ্তর সম্পাদক বাবুলসহ । এছাড়াও  রিফাত, আরিফুজ্জামান ইমন, গাজীউর, শাহিদ হাসান ও মামুন। এর সাথে  বহিরাগত ৮-৯ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতোমধ্যে  বহিষ্কৃত  ৭ জন কর্মকর্তা ও ২ জন শিক্ষক সহ সর্বমোট ৩০ থেকে ৩৫ জনের একটি তালিকা করে বাকি কয়েকজনকে অজ্ঞাতনামা রেখে মামলা করার পরিকল্পনা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। তবে এতে মামলা থেকে বাদ পড়বেন হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এবং ইন্ধনদাতা হিসেবে অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী। 

সূত্র জানায়, নতুন করে এসকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে মামলার আসামি করা হলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ অস্থিতিশীল হওয়ার অজুহাতে  তথ্য প্রমাণ থাকার পরও এদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থাও নেয়নি প্রশাসন।

গত ২৭ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য বরাবর  বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনচলাকালীন হামলার অভিযোগে সমন্বয়করা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান কর্মরত ও বহিরাগতের বিরুদ্ধে নাম উল্লেখ করে দুইটি অভিযোগ দায়ের করেন। এতে একটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমান কর্মরত ২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের উপর হামলার কথা উল্লেখ করে তাদের শাস্তি দাবি করেন। অভিযোগে তারা উল্লেখ করেন, সিসি টিভির ফুটেজ, বিভিন্ন ছবি থেকে এসকল হামলাকারীকে তারা শনাক্ত করেছেন এবং তাদের স্পষ্টভাবে দেখা গিয়েছে বলেও অভিযোগে উল্লেখ আছে। 

এদের মধ্যে গণিত বিভাগের উপ-রেজিস্ট্রার আনোয়ার হোসেন, সাবেক ভিসির পিএ ও নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ,যিনি ১৬ জুলাই হামলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেন, জুলাই বিপ্লবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ওপর দমন-নিপীড়নের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা কিছু ফুটেজ ভাইরাল হয়। সেখানে ১১ জুলাই মিছিলে বাধা দিতে দেখা গেছে সাবেক উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) ও নিরাপত্তা দপ্তরের কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদকে। তিনি রংপুর সদরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমন্বয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, হাতে লাঠি নিয়ে হামলার নির্দেশ দিচ্ছিলেন বহিষ্কৃত সেকশন অফিসার মনিরুজ্জামান পলাশ। হেলমেট পড়ে হামলায় অংশ নেন ডেসপাস শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার মোক্তারুল ইসলাম ও পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কর্মচারী ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মাহবুবার রহমান এবং প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তা রফিউল ইসলাম রাসেল।

আন্দোলনকারীদের আক্রমণের উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে ছাত্রলীগ ও পুলিশের পাশে হাতে ইট নিয়ে দেখা যায় নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার কর্মচারী ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি নুর আলম মিয়াকে ও কর্মচারী নূর নবীকে পুলিশের অগ্রভাগ থেকে ঢিল মারতে মারতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বলে অভিযোগে উল্লেখ আছে। এছাড়া লাল পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় হামলাকারীদের সাথে  নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার উপ-রেজিস্ট্রার হাফিজ আল আসাদ রুবেল ও হলুদ গেঞ্জি পরিহিত অবস্থায় হামলা করতে দেখা যায় মার্কেটিং বিভাগের কম্পিউটার অপারেটর আহসান হাবীব তুষারকে এবং সাদা গেঞ্জি পরিহিত সিকিউরিটি গার্ড নুর আলমকেও দেখা যায়। 

এছাড়াও ১৬ জুলাই সরাসরি হামলায় জড়িত বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়,  নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখার সহকারী রেজিস্ট্রার শাহিন মিয়া ওরফে শাহিন সর্দারের নাম, পেনশন শাখার উপ-পরিচালক রিয়াজুল ইসলাম, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর নুরুজ্জামান, ভূগোল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে কর্মচারী বিপ্লব,  তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মাসুম খান, প্রক্টর অফিসের কর্মচারী আপেল, একাউন্টস বিভাগে কর্মরত রিয়াজুল , ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের সেকশন অফিসার এ কে এম রাহিমুল ইসলাম দিপু, সংস্থাপন শাখা-১ এর কর্মচারী সবুজ মিয়া ও ক্যাফেটেরিয়ার সহকারী রেজিস্ট্রার রেজাউল ইসলাম লাবু, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তরের উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এরশাদুজ্জামান কাজল, স্টোর কিপার তুফানসহ অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘটনার সময় উপস্থিত ছিলেন বলে অভিযোগ পত্রে উল্লেখ করা হয়।

এছাড়া অভিযোগপত্রে ভিসির বাসভবনে বসে হামলার পরিকল্পনা করী হিসেবে সাবেক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ নেতা ও পরিবহন শাখার অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার তাপস কুমার গোস্বামীকে এবং ট্রেজারার অফিসে কর্মরত মাজহারুল আনোয়ারের নাম উল্লেখ করা হয়। তাপস ১৪ ও ১৫ জুলাই ছাত্রদের ওপর হামলার সময়ও ছাত্রলীগকে মদদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়। 

ব্যবস্থা না নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব প্রদান: জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত এ সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বিরুদ্ধে আট মাস অতিবাহিত হলেও প্রশাসন এ নিয়ে কোন তদন্ত কমিটি গঠন করেননি এবং তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেয়নি। উল্টো এদের মধ্য থেকে অন্তত সাত জনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠিত ঢাকা, রাজশাহী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গুচ্ছভুক্ত ও কৃষি গুচ্ছের ভর্তি পরীক্ষায় নিরাপত্তা ও শৃঙ্খলা কমিটিতে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে তাপস কুমার গোস্বামী, রেজাউল ইসলাম লাবু ও  শাহিন মিয়াকে মেইন গেটের নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। শাহিন মিয়াকে নিরাপত্তা শাখা থেকে বদলি করে প্রক্টর অফিসের মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় আনা হয়েছে। সাদা হাফ শার্ট পরিহিত হামলার সময় উপস্থিত সবুজ মিয়াকে সংস্থাপন শাখা থেকে বদলি করে বহিরাঙ্গন পরিচালকের মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হয়, ভর্তি পরীক্ষাচলাকালীন সময় সবুজ অ্যাকাডেমিক ভবন-২ এর নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া ৩নং গেইটে দায়িত্ব পালন করছেন নুর আলম মিয়া, ৪ নং গেইটে হাফিজ আল আসাদ। এছাড়া সাবেক ভিসির পিএ আবুল কালাম আজাদকে নিরাপত্তা ও পরিচ্ছন্নতা শাখায় বদলি করা হয়েছে, আবুল কালামের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের উপর হামলার মদদ ও রংপুর সদরের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সমন্বয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে অবস্থান করার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা  অভিযোগ থাকলেও তাকে জিরো পয়েন্টের নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। 

এই ব্যাপারে শহীদ আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শামসুর রহমান সুমন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হামলাকারীদের ওপর মামলা করতে চাইলে আমরা সাক্ষীর একটা তালিকা জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসনের অবহেলার জন্যই এখনো কোনো মামলা করা হয়নি। আশ্বাসে সীমাবদ্ধ না থেকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আমরা আবারো আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।

শহীদ আবু সাইদের সহযোদ্ধা রোবায়েদ জাহিন বলেন, আমি মামলা না হওয়ায় হতাশ।  প্রথম থেকে প্রশাসন ধীর গতিতে কাজ করছে। তদন্ত কমিটি গঠন করেও এখনও মামলা করতে পারেনি, এইটা প্রশাসনের ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। 

জুলাই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের পাশে থাকা পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষক ফারজানা জান্নাত তসি বলেন, আবু সাঈদ মারা গেছে গত প্রশাসন গুলোর দীর্ঘ ব্যর্থতার কারণে। জুলাই আন্দোলনে ১৪'শ মানুষ মারা গেছে পার্সপেক্টিভ ভিন্ন আর আবু সাঈদের পার্সপেক্টিভ ভিন্ন। আবু সাঈদ তার ক্যাম্পাসের সামনে মারা গেছে। আমার ছাত্র আমার ছাত্রকে মারার জন্য উষ্কাই দিছে। আমার মনে হয় এই প্রশাসন এই জায়গায়টায় কোনো কাজ করেনি। 

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড.মো. শওকাত আলী বলেন, আমরা হামলাকারীদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছি। এ বিষয়ে জুলাই আগস্টে আহতদের সাক্ষীও আমরা নিয়েছি। মামলার প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে।

উল্লেখ্য, গত ২০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৯তম সিন্ডিকেট সভায় আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৭১ শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন মেয়াদে সেমিস্টার অনুযায়ী সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শৃঙ্খলা বোর্ড ২৩ জনকে এক সেমিস্টার, ৩৩ জন দুই সেমিস্টার ও ১৫ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এসব কর্মকর্তা-কর্মচকর্মচারীর বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীরা।