ববি প্রকৌশল শাখা মুরশিদ আবেদিনের নিয়ন্ত্রণে!
প্রকাশ | ২৬ মে ২০২৫, ১৭:০২ | আপডেট: ২৬ মে ২০২৫, ১৭:৩৯

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) গত কয়েক বছরে বড় কোনো উন্নয়ন প্রকল্প না এলেও, ছোট ছোট কাজের পেছনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব কাজের অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণ করছে একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। উপ- প্রধান প্রকৌশলী মুরশীদ আবেদিনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে এসব কাজে অনিয়ম, দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও আর্থিক লুটপাটের একাধিক অভিযোগ উঠেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ‘মনু’ নামে এক ঠিকাদারকে সামনে রেখে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণকাজে একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন উপ-প্রকৌশলী মুরশীদ আবেদিন। তিনি নিজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন।
উপ-প্রকৌশলী মুরশীদ আবেদিন সরাসরি বা পরোক্ষভাবে এই তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো ধারা এন্টারপ্রাইজ, আমেনা কনস্ট্রাকশন এবং এমএস মাকিন ট্রেডার্স। সূত্রের দাবি, এমএস মাকিন ট্রেডার্স আনুষ্ঠানিকভাবে তার ভাইপোর নামে থাকলেও প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্বে রয়েছেন মুরশীদ আবেদিন নিজেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের একাধিক সূত্র বিষয়গুলোর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তারা জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ নির্মাণ কাজ ঘুরে ফিরে এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই সম্পন্ন হচ্ছে। মুরশীদ আবেদিন একটি ‘সিন্ডিকেট’ গঠন করেছেন, যার মাধ্যমে বাইরের কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ করতে দেয়া হয় না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কার্যক্রমে প্রতিযোগিতাহীনতা, অনিয়ম ও স্বচ্ছতার অভাব স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানিয়েছে, বিল উত্তোলনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে অনিয়ম ধরা পড়ায় অর্থ দপ্তরের এক কর্মকর্তা চেক ইস্যু করতে অস্বীকৃতি জানান। এর জেরে ওই কর্মকর্তাকে হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়, যার একটি লিখিত অভিযোগও রয়েছে।
সূত্রগুলো আরও জানায়, তদন্ত চলাকালীন সময়ে তাকে দাপ্তরিক কাজ থেকে অব্যহতি দিলেও তার ‘প্রভাব’ এবং ‘সংযোগ’ এর কারণে এসব বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে নি তৎকালীন প্রশাসন। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও দীর্ঘ ছয় বছরেও তদন্ত শেষ করতে পারেনি কমিটি। এ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর টেন্ডার আহ্বান প্রক্রিয়ায় নিজের মতো করে কঠিন শর্ত আরোপ করে। এতে অনেক যোগ্য প্রতিষ্ঠান টেন্ডার জমা দিতে পারে না। যারা দেয় তারাও প্রকৌশলীর কারসাজিতে কাজ পায় না কারন আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে ‘পছন্দের ঠিকাদার’ ।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ঠিকাদার জানান, “টেন্ডারে অংশ নিতে গিয়ে দেখা যায় এত পরিমাণ কাগজপত্র চায়, যা খুব কম ঠিকাদারেরই থাকে। আর যেসব ঠিকাদার টেন্ডার জমা দেয়, তাদের রেট আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়। পরে দেখা যায় মুরশীদ আবেদীনের ঘনিষ্ঠ ঠিকাদার এক দুই টাকা কম রেট দিয়ে কাজ পেয়ে যায়।”
প্রাপ্ত নথিপত্রে দেখা যায়, এমএস মাকিন ট্রেডার্স গত বছরের এপ্রিল ও জুন মাসে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, ভবন ও সড়ক মেরামত, এবং অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ক্রয়ের মাধ্যমে ১৪ লাখ টাকার ৮টি কাজ পেয়েছে। অন্যদিকে, ৫১ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি অস্থায়ী গ্যারেজ নির্মাণের কাজ পায় ধারা এন্টারপ্রাইজ। তাদের অফিস ঠিকানা দেওয়া হয়েছে বরিশালের ব্যাপ্টিস্ট মিশন রোড, তবে সেখানে প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব মেলেনি।
২০২১ সালের জানুয়ারিতে কাজের ওয়ার্ক অর্ডার হলেও তিন মাসের কাজ শেষ হয় ছয় মাসে, বিলও ধাপে ধাপে বাড়ানো হয়। প্রতিষ্ঠানটির দেওয়া মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। ধারা এন্টারপ্রাইজ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আওলাদ হোসেন মনুই কাজটি করেছেন বলে স্বীকার করেছেন। এদিকে মনুর নিজের নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আমেনা কনেস্ট্রাকশন।
পুলিশ বক্স নির্মাণের ১৬ লাখ টাকার প্রকল্পে মুরশীদ আবেদীন নিয়মবহির্ভূতভাবে দুটি ধাপে আরএফকিউ পদ্ধতিতে দরপত্র আহ্বান করেন, যাতে নিজের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া সহজ হয়। বিষয়টি নিয়ে অডিট আপত্তিও দেয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের তাপসী রবেয়া বসরী হলের এপ্রোন ড্রেন নির্মানের ২১ লক্ষ টাকার কাজটিও আমেনা কনেস্ট্রাকশন পেয়েছে বলে জানা গেছে। কাজটি চলমান রয়েছে। অন্যদিকে কোনো মাস্টারপ্ল্যান ছাড়াই নির্মিত মাত্র দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি একতলা স্কুল ভবনে ব্যয় দেখানো হয়েছে প্রায় ৪৩ লাখ টাকা। সুফিয়া কামাল হলের পাশে নামপত্র ড্রেন নির্মাণে খরচ দেখানো হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানটি ঘুওে ফিরে কাজ পাচ্ছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে ‘মনু’ নামে পরিচিত ঠিকাদার আওলাদ হোসেন মনু বলেন, “আমি বিভিন্ন লোকের নামে কাজ করি।” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আরেক ঠিকাদারকে দেখিয়ে তিনি বলেন, “আমি মাঝে মাঝে তার নামেও কাজ করি। ধারা এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠানের নামে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্যারেজের কাজ করেছি।”
প্রতিনিয়ত ঘুরে ফিরে তারই প্রতিষ্ঠান কাজ পেয়ে যাচ্ছে - এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “মুরশীদ আবেদিন আমার বস। আমি ওপেন বিডিংয়ের মাধ্যমেই প্রত্যেকটা কাজ করি।”
এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-প্রকৌশলী মুরশীদ আবেদিন বলেন, “মনু নামে পরিচিত ঠিকাদার অধিকাংশ কাজ পায় না এবং আমি তাকে কোনো কাজ দেই না। যে কাজগুলো সে পায়, তা অফিসিয়ালি টেন্ডারের মাধ্যমে পায় সেখানে আমার কোনো প্রভাব থাকে না। কোটেশন পদ্ধতিতে আমি কাজ দিতে পারি । তবে আমি ভবিষ্যতে তাকে (মনু) আর কোনো কাজ দিবো না । ভিসি স্যারও বলেছেন, এখন থেকে সব কাজ ওপেন টেন্ডার প্রক্রিয়ায় করতে ।”
তার ভাতিজার মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কীভাবে কাজ পায়-এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এ অর্থবছরে ওই প্রতিষ্ঠানের মাত্র একটি কাজ রয়েছে। আমি তাকে কোনো কাজ দিয়ে সহায়তা করি না।”
সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড মোহাম্মাদ তৌফিক আলম যায়যায়দিনকে বলেন,“আমি নতুন এসেছি। অনেক বিষয়ই জানি না । আপনারা আমাকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারেন। তবে কোনো তথ্য প্রমান পেলে আমি অবশ্যই সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নিবো।”