ভাইভা বোর্ডে প্রশ্নের সব উত্তর দিয়েও ফেল
প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২৫, ১৮:০৫

বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) কার্যালয়ের সামনে টানা বৃষ্টির ভেতর চায়ের দোকানের ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে ছিলেন জাকির হোসেন। হাতে ধরা একটি ফাইলে গুছিয়ে রাখা রয়েছে তাঁর জীবনভর অর্জনের সনদ—এসএসসি থেকে শুরু করে কামিল পর্যন্ত। কিন্তু সেই কাগজগুলো আজ যেন মূল্যহীন হয়ে গেছে। কারণ, ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের ভাইভা বোর্ডে প্রশ্নের উত্তর দিয়েও তিনি ফেল হয়েছেন।
জাকির হোসেন নোয়াখালীর ইসলামি কামিল মাদ্রাসা থেকে প্রথম বিভাগে কামিল পাস করেছেন। দাখিল ও আলিম—উভয় পরীক্ষাতেই জিপিএ ৫ অর্জন। নিবন্ধনের এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর আশা ছিল এবার হয়তো স্বপ্ন পূরণ হবে। কিন্তু ভাইভা পরীক্ষার ফলাফল সেই স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে।
“ভাইভা বোর্ডে আমাকে ১২টি প্রশ্ন করা হয়, যেগুলোর প্রায় সবই আরবি ব্যাকরণভিত্তিক ছিল। আমি প্রতিটি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছি। উপস্থিত পরীক্ষকেরা তখন সন্তুষ্ট বলেও মনে হয়েছিল। কিন্তু চূড়ান্ত ফলাফলে আমাকে ফেল দেখানো হয়েছে,” বলেন জাকির হোসেন।
তাঁর অভিযোগ, ভাইভা বোর্ডে বড় রকমের বৈষম্য ও মূল্যায়নের গাফিলতি রয়েছে। “আমার বোর্ডে ৩০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ১০ জনকে পাস করানো হয়েছে। অথচ আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে, এই হার প্রায় ৯৫ শতাংশ ছিল। এ বছর হঠাৎ এতগুলো ফেল কেন?”—তিনি প্রশ্ন রাখেন।
এনটিআরসিএ ১৮তম নিবন্ধনের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশ করে গত ৪ জুন। ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, কিছু ভাইভা বোর্ডে ৩০ জনের মধ্যে মাত্র ১-৩ জন উত্তীর্ণ হয়েছেন, আবার অন্য বোর্ডে ২৯ জন পর্যন্ত পাস করেছেন। বিষয় ও বোর্ডভেদে এমন বিশাল বৈষম্য প্রশ্ন তুলেছে প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে।
এ ব্যাপারে লালবাগ মাহমুদা খাতুন মহিলা কামিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও এক ভাইভা বোর্ডের পরীক্ষক মুফতি বদিউল আলম সরকার জানান, “যেসব প্রার্থী আরবি বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞানও দেখাতে পারেননি, তাঁদের ফেল করানো হয়েছে।” তবে একই বিষয়ের অন্য বোর্ডের কিছু পরীক্ষক বলেছেন, “৩০ জনের মধ্যে ২৮–২৯ জন ফেল করানো সাধারণ বিষয় হতে পারে না। এটি অবশ্যই পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে।”
চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর থেকে অসন্তোষে ফেটে পড়েন বহু ভুক্তভোগী। কেউ এসেছেন চট্টগ্রাম, কেউ চাঁদপুর, কেউ ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে। তাঁদের দাবি একটাই—ভাইভা পরীক্ষার ফলাফল পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে এবং যোগ্যদের সনদ দিতে হবে।
জাকির হোসেন বলেন, “নিবন্ধনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় আমরা সারা বছর প্রস্তুতি নিই। পরীক্ষায় ভালো করেও যদি শুধুমাত্র বোর্ডভেদে বৈষম্যের কারণে ফেল হতে হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আর কীসের আশায় প্রস্তুতি নেব?”
সোমবার এনটিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে আন্দোলনরতদের পক্ষ থেকে ছয় সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলকে ডেকে পাঠায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ‘যমুনা’। প্রতিনিধি দলের সদস্যদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টার সহকারী একান্ত সচিব শাব্বীর আহমদ। আন্দোলনকারীদের দাবি শোনার পর তিনি আশ্বাস দেন, বিষয়টি এনটিআরসির সঙ্গে সমন্বয় করে সমাধান করার চেষ্টা হবে।
এছাড়া, এনটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মুহাম্মদ নূরে আলম সিদ্দিকী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর একটি চিঠিও পাঠিয়েছেন। পাশাপাশি বঞ্চিত প্রার্থীদের একটি প্রতিনিধি দল সচিবালয়ে গিয়ে শিক্ষা সচিবের সঙ্গে দেখা করে নিজেদের অভিযোগ তুলে ধরেছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসা আরেক আন্দোলনকারী মাহমুদা বেগম জানান, “আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে এমএসসি করেছি। ভাইভায় আমাকে ৮টি প্রশ্ন করা হয়, সবগুলোর উত্তর দিয়েছি। তবু ফেল। এটা চরম অবিচার।”
তিনি বলেন, “আমাদের বোর্ডে ৪ হাজারের বেশি পরীক্ষার্থী থাকলেও ভাইভায় পাস করেছে মাত্র ৫০৪ জন। অথচ কোটা ছিল তার চেয়েও বেশি। তাহলে বাকিরা গেল কোথায়?”
চাঁদপুর থেকে আসা প্রিয়াঙ্কা, ঢাকার সোহেল হোসেনসহ বহু প্রার্থী একই অভিযোগ করেছেন—ভাইভা বোর্ডে মতাদর্শগত পক্ষপাতিত্ব ও অস্বচ্ছ মূল্যায়নের শিকার হয়েছেন তাঁরা।
“আমরা শিক্ষক হতে চেয়েছিলাম, রাস্তায় আন্দোলন করতে নয়,”—আক্ষেপের সুরে বলেন জাকির হোসেন। তাঁর মতো শত শত মেধাবী তরুণ আজ রাজপথে, একটাই প্রত্যাশা নিয়ে—ন্যায়বিচার ও স্বীকৃতি।