লোমহর্ষক বর্ণনা: ছাত্রলীগের হাতে পা বিচ্ছিন্ন হওয়ার কথা জানালেন রাবি শিক্ষার্থী
প্রকাশ | ১৮ জুন ২০২৫, ১৮:২০

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) পরীক্ষার হলে শিবিরের কয়েকজন শিক্ষার্থী আসার খবরে চতুর্দিকে ঘিরে ফেলে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী নিষিদ্ধ সংগঠনের ছাত্রলীগের ২৫-৩০ জন নেতাকর্মীরা। সে সময় পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের সামনে এক শিক্ষার্থীকে গুলি ও চাপাতি দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে ডান পা বিচ্ছিন্ন করে দেয় তৎকালীন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা।
২০১৪ সালের ১৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদুল্লাহ কলা ভবন এ ঘটনা ঘটে। পরে আহতাবস্থা দুই ছাত্রশিবির নেতাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ।
মো. রাসেল আলম (তৎকালীন নবাব আব্দুল লতিফ হল সেক্রেটারি) -এর বক্তব্য ওঠে আসে লোমহর্ষক ঐ ঘটনার বর্ণনা।
তিনি বলেন, "ছাত্রলীগ সেদিন শহিদুল্লাহ কলা ভবনের গেট বন্ধ করে দেয়। আমি তখন ভেতরে আটকা পড়ে যাই। কিছুক্ষণ পর পুলিশ এসে হাসিব ভাই ও মঞ্জুর ভাইকে (ছাত্রশিবির নেতা) গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। আমাকে পুলিশ কিছু না বলায় আমিও চুপচাপ থাকি। গেটের বাইরে পুলিশের আরেকটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। কিন্তু তখনও আমি বুঝতে পারিনি আমাকে নিয়ে ওরা কি জঘন্য চক্রান্ত করে রেখেছে!
বেলা তিনটার দিকে প্রায় ২৫-৩০ জন অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ আমাকে ঘিরে ফেলে এবং একটা রুমের ভেতরে নিয়ে যায়। তাদের হাতে বন্দুক, চাপাতি, হকিস্টিকসহ বিভিন্ন ধারালো অস্ত্র। তারা এক ঘন্টা ধরে আমাকে আটকে রেখে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। ছাত্রলীগের তৎকালীন বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ আল হোসেন তুহিন ছিল সেখানে। বেলা চারটার দিকে আমি তাকে বলি, তোমাদের কারো তো আমি কোন ক্ষতি করিনি, আমাকে যেতে দাও। এই বলে পিছন ফিরে পা বাড়াতেই রিনেট নামের এক ছাত্রলীগ কর্মী আমাকে পিঠে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। কি হলো বুঝার জন্য ঘুরে দেখা মাত্রই অন্য কেউ আমার হাতে আরেকটা চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। আমার হাত কব্জি থেকে কেটে চামড়ার সাথে ঝুলতে থাকে।
আমি ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হওয়ারও সময় পাইনি। ছাত্রলীগ নেতা ফয়সাল আহমেদ রুনু (পরবর্তীতে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ সম্পাদক) আমার দুই পায়ে গুলি করে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। আমাকে এই অবস্থায় ফেলে তারা সবাই চলে যাচ্ছিল, কিন্তু ছাত্রলীগ নেতা গোলাম কিবরিয়া (পরবর্তীতে রাবি ছাত্রলীগ সভাপতি) ফিরে এসে চাপাতি নিয়ে আমার পায়ে কোপাতে থাকে। আমি আমার পায়ের অনুভূতি পাচ্ছিলাম না। আমাকে ওরা আঘাত করছে অথচ আমি কিছুই বুজছি না। ভয়ংকর কিছু হয়ে গেছে সেটাও বুঝতে পারিনি।
আমাকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ওরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়াতে গিয়ে দেখি আমার এক পা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেও যেই আমি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ছিলাম, মুহূর্তের মধ্যেই সেই আমি ছাত্রলীগের নৃশংসতায় একেবারে পঙ্গু হয়ে গেলাম। রক্তের ধারা বয়ে যাচ্ছিল আমার শরীর দিয়ে। সারা শরীর ভালভাবে দেখলাম, মনে হলো আমি পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছি। মুহূর্তের মধ্যেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেলাম ও কয়েকবার তওবা পরে নিলাম। এরপর মনে মনে বলছিলাম, হে আল্লাহ আমি শহিদি মৃত্যু চেয়েছিলাম, তুমি কবুল করেছ, আলহামদুলিল্লাহ। তুমি শুধু আমার বাবা-মাকে ধৈর্যধারণ করার তৌফিক দিও। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। আমাকে নিয়ে তাদের দুনিয়ার সকল স্বপ্ন ধ্বংস হয়ে গেল, তুমি তাদের আখিরাতে প্রতিদান দিও।
এরপর আমি মৃত্যুর অপেক্ষা করছি। এভাবে বেশকিছুটা সময় নিজের রক্তের ভিতরে ডুবে ছিলাম। কিছুক্ষণ পরে পুলিশ আসে। তখনকার মতিহার থানার ওসি আলমগীর আমাকে পুলিশ ভ্যানে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যান। শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত থাকায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিক্স বিভাগের প্রধান ডা. বি. কে. দাম আমার অপারেশন করতে অস্বীকৃতি জানায়।
রক্তক্ষরণ আটকাতে আমার পা বেধে রাখা হয়েছিল। পায়ে কোন অনুভূতি না থাকলেও কোমরে প্রচন্ড ব্যাথা করছিল। প্রায় এক ঘন্টা ধরে যন্ত্রনায় চিৎকার চেঁচামেচির পর আমার অপারেশন শুরু করে। দীর্ঘ ৬ ঘণ্টা অপারেশন শেষে আমাকে আইসিইউতে শিফট করে। তারপর আইসিইউতে আমাকে পুরনো মামলায় গ্রেফতার করা হয়। আমি পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে থাকি। আমার সাথে কারো দেখা করার ব্যাপারেও বিধিনিষেধ ছিল। এই অবস্থায় কাউকে গ্রেফতার করা হতে পারে আমার কল্পনাতেও ছিলো না।"