‘হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যুর ১০ মাস পর হত্যা মামলা, কারাগারে বেরোবি শিক্ষক

প্রকাশ | ২০ জুন ২০২৫, ০৯:৩৫

বেরোবি প্রতিনিধি
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহামুদুল হককে গ্রেফতার করা হয়েছে

রংপুরে পুলিশের ধাওয়া খেয়ে হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া এক ব্যক্তির মৃত্যুর ১০ মাস পর দায়ের করা হত্যা মামলায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহামুদুল হককে গ্রেফতার করা হয়েছে। 

তবে এই মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের নেতারা। কারণ, মামলায় পলাতক শেখ হাসিনা ও ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদেরও আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে মাহামুদুল হককে নগরীর ধাপ ইঞ্জিনিয়ার পাড়ার নিজ বাসা থেকে গ্রেফতার করে মহানগর হাজিরহাট থানার পুলিশ। 

এর পর তাকে আদালতে তোলা হয়। আদালত তার জামিন মঞ্জুর না করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। মাহমুদুল হকের সহধর্মিণী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

জানা গেছে, মাহামুদুল হক ওই মামলার ৫৪ নম্বর আসামি। গত ৩ জুন নগরীর রাধাকৃষ্ণপুর এলাকায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া মুদি দোকানদার সমেছ উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগম স্বামী হত্যায় হাজিরহাট থানায় ৫৪ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা দায়ের করেন। 

মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। এছাড়াও, আসামি হিসেবে আছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। বাকি ৫২ জনই স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষ। 

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুল হককেও আসামি করা হয়।

এ ঘটনায় মাহমুদুল হকের সহধর্মিণী মাসুবা হাসান মুন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমার হাজবেন্ড মো. মাহামুদুল হক সহকারী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর; গতকাল বিকেল আনুমানিক সাড়ে ৩ টার দিকে আমার রংপুরের ধাপ এলাকায় অবস্থিত নিজ বাসা থেকে রংপুর মেট্রোপলিটন হাজিরহাট থানা পুলিশ আমার হাজবেন্ডকে আটক করে সরাসরি আদালতে নিয়ে যায়। 

কোনো এক হত্যা মামলার অভিযোগের প্রেক্ষিতে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমার হাজবেন্ড এরকম কোনো অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন‌ না। তিনি পুরোপুরিভাবে নির্দোষ। এটি একটি পরিকল্পিতভাবে সাজানো মিথ্যা মামলা। 

আমি আমার হাজবেন্ডের স্নেহভাজন শিক্ষার্থী, সম্মানিত সহকর্মী, সাংবাদিকতা পেশার সহকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষী সকলের পক্ষ থেকে সহযোগিতা কামনা করছি।’

এ ঘটনা জানাজানি হয়ে রংপুরসহ রাজধানীজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। এদিকে নিহত সমেছ উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগম ও তার ছেলে আশিকুর রহমান স্বীকার করেছেন যে, তাদের বাবা পুলিশের ধাওয়া খেয়ে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। 

তারা মামলা করেছে পুলিশের কথামতো। মামলায় কাদের আসামি হয়েছে তা তারা জানেন না। 

কেবলমাত্র কাগজে সই দিয়েছেন তারা। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, জুলাই আন্দোলনের সময় ২ আগস্ট তারিখে মুদি দোকানদার সমেছ উদ্দিন দোকানে বসে থাকা অবস্থায় জামায়াত নেতা হাজি নাছির উদ্দিনকে পুলিশ আটক করতে ওই এলাকায় এলে সমেছ উদ্দিন ভয়ে দোকান থেকে নেমে দৌড় দেয়। 

কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তায় শুয়ে পড়ে জ্ঞান হারায়। স্বজন ও এলাকাবাসী তাকে উদ্ধার করে বাড়ির কাছে বেসরকারি প্রাইম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার জানান, তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন।

তবে অভিযোগ উঠেছে, ১০ মাস পর যে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে সেখানে উল্লেখ করা হয়, সমেছ উদ্দিনকে বাড়ির কাছে নজিরের হাট এলাকায় কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। 

তবে তার মরদেহের কোনো ময়নাতদন্ত হয়নি। উলটো হত্যা মামলা দায়ের করার পরও লাশ তুলে ময়নাতদন্তের কোনো উদ্যোগ নেয়নি পুলিশ।

মামলার এজাহারে বাদী সমেছ উদ্দিনের স্ত্রী আমেনা বেগম অভিযোগ করেন— “বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দমন করার আসামিরা গত ২ জুলাই সন্ধ্যায় রাধাকৃষ্ণপুর এলাকার তাঁর বসতভিটাসংলগ্ন মুদি দোকানে সমেছ উদ্দিনকে আসামিরা নেমে আসতে বলে। এ সময় মুদি দোকানদার সমেছ উদ্দিন টের পেয়ে দোকান থেকে পালানোর চেষ্টা করে। 

অপরদিকে মৃত সমেছ উদ্দনের ছেলে আশিকুর রহমান বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি রংপুরের বাইরে ছিলাম। আমার বাবাকে পুলিশ ধরতে এলে তিনি দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করলে মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।’ 

তবে যারা তার বাবাকে ধরতে এসেছিল তাদের বিচার দাবি করেন তিনি। তবে অকপটে স্বীকার করেন তার বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। 

সমেছ উদ্দিনের মরদেহ জানাজায় ইমামতি করা স্থানীয় মসজিদের ইমাম মমিনুল ইসলাম জানান, তিনি জানাজা পড়িয়েছেন। নিহতের শরীরে কোনো জখম দেখেননি। হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়ার কথা শুনেছেন। হত্যার কথা শোনেননি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, স্থানীয় ওয়ার্ড জামায়াতের আমির হাজি নাছির উদ্দিনকে ২ আগস্ট তারিখে কয়েকজন পুলিশ গ্রেফতার করার জন্য তার বাসা ঘেরাও করে। 

ওই সময় মুদি দোকানদার সমেছ উদ্দিন ভয়ে দোকান থেকে নেমে পালানোর চেষ্টা করে কিন্তু হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। 

স্বয়ং স্থানীয় ওয়ার্ড জামায়াতের আমির হাজি নাছির উদ্দিন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মুদি দোকানদার সমেছ উদ্দিনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে আসে নাই। পুলিশ এসেছিল আমাকে গ্রেফতার করতে।’ আর এই মামলায় বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষকে আসামি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে জানা গেছে, সমেছ উদ্দিন হত্যা মামলা দায়ের হওয়ার পর স্থানীয় সাধারণ মানুষ ও জামায়ত-বিএনপির নেতাকর্মীদেরও আসামি করা হয়েছে। 

মামলার আসামিদের স্বজনরা বলেন, সমেছ উদ্দিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। এটাই শত ভাগ সত্য। অথচ এ ঘটনাকে লুকিয়ে করে মিথ্যা হত্যা মামলা দায়ের করে তাদের স্বজনসহ এলাকার নিরীহ মানুষকে আসামি করা সম্পূর্ণ অন্যায়।

রংপুর মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামু বলেন, ‘সমেছ উদ্দিন হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন। এ ঘটনায় ২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জয়নালসহ স্থানীয় নিরীহ ব্যক্তির নামে হত্যা মামলা দায়ের করা সত্যিই দুঃজনক।’ 

তিনি বলেন, ‘সমেছ উদ্দিনের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট কই? ১০ মাস পর মামলা করা হলো। এখনো লাশ উত্তোলনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন?’ পুরো ঘটনা তদন্ত করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

অন্যদিকে ২৮ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি আলমগীর বলেন, ‘আমি হাজিরহাট থানায় গিয়ে ওসির সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞাসা করি, হার্ট অ্যাটাকে মারা যাওয়া ব্যক্তিকে কীভাবে হত্যা করার গল্প সাজানো হয়। পুলিশ কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।’ তিনি অভিযোগ করেন, নিরীহ লোকদের আসামি করে মামলা বাণিজ্য করা হচ্ছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে রংপুর মেট্রোপলিটন হাজিরহাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আব্দুল আল মামুন শাহ এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। 

ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন নাই, তাহলে কীভাবে হত্যা মামলা রেকর্ড করলেন? মামলায় আসামিদের গ্রেফতারের নামে হয়রানির অভিযোগ করা হচ্ছে কেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি উপর মহলের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। মামলার বাদীকে থানায় স্বয়ং ওসি ডেকে নিয়ে হত্যা মামলা নিয়েছেন- এমন অভিযোগ করলে তিনি কোনো উত্তর দেননি।

এদিকে, মাহামুদুল হককে গ্রেফতারের নিন্দা জানিয়েছেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান। তিনি তার নিজের ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে বেরোবির এই শিক্ষকের দ্রুত মুক্তি দাবি করেছেন।