‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যাত্রা এখানেই শেষ’

প্রকাশ | ২৮ জুন ২০২৫, ০৯:৪২

যাযাদি ডেস্ক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা। ছবি- সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেছেন, নির্বাচনে অংশ না নেয়া একজন এসে মেম্বার হয়ে গেছে কাউন্সিলের। এসব দেখে আমি অত্যন্ত লজ্জিত। তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা এখানেই শেষ হলো। 

শুক্রবার (২৭ মে) রাতে নিজের ভেরিফাইড ফেসবুকে দেওয়া এক পোস্টে এ কথা জানান তিনি।

তিনি লিখেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হয়েছে গত পরশু। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে আমার আনুষ্ঠানিক যাত্রা এখানেই শেষ হলো। এনসিপি নামক রাজনৈতিক দলটি গঠনের পর আমি জুলাইয়ের অসমাপ্ত কাজগুলো করার দায়বদ্ধতা থেকে এই ব্যানার নিয়ে কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু দলীয় লেজুড় ও প্রেসক্রিপশনের বাইরে এই ব্যানারটি স্বাধীনভাবে কাজ করলে অনেকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়ত। তাই আমার ওপর অনলাইন, অফলাইনে ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করা হয় যাতে আমি এই ব্যানার নিয়ে কাজ না করি। আমি পুরা বিষয়টাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েই একটা Goodwill থেকে ব্যানারকে সচল করার চেষ্টা করেছিলাম।

উমামা ফাতেমা লিখেছেন, পরবর্তী পরিস্থিতি নিয়ে আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই। যে মানুষগুলার সঙ্গে আমি পাশে দাঁড়ায়ে মিটিং করছি, মিছিল করছি তারাই পরিকল্পিতভাবে জুনিয়রদের দিয়ে আমার বিরুদ্ধে Smear campaign চালায়। মানুষ বাইরে যত ভালো সাজার চেষ্টা করুক ভিতর থেকে কতটা ছোটলোক হতে পারে আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই ওই সময়গুলাতে। এসো কল্ড সহযোদ্ধারা মানুষকে টিস্যু পেপারের মতো ব্যবহার করে, প্রয়োজন শেষ হলে ছুঁড়ে ফেলতে এক মুহূর্তও লাগে না। আমি মার্চ-এপ্রিল মাসে এই প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি পোকার মতো ভিতর থেকে প্ল্যাটফর্মকে সুবিধাবাদীরা খেয়ে ফেলেছে।  হ্যাঁ, আমি বলব বিভিন্ন শাখা কমিটিতে অনেক Goodwill এর মানুষ ছিল, যারা পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে কমিটিতে আসছিল। চেষ্টা করছে কাজ করার। কিন্তু তারাও এই সুবিধাবাদীদের কাছে জায়গা করতে পারেনি।

তিনি লিখেছেন, আমার সঙ্গে অনেকের কথা হয় এখনো। ব্যক্তিগত জায়গা থেকে চেষ্টা করি সাজেশন দেয়ার, হেল্প করার। জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এত বড় ইভেন্ট দেখার পর চোখের সামনে সবকিছু ভেঙে পরতে দেখাটা অনেক অনেক কঠিন। পরবর্তীতে আমার বন্ধু, শুভানুধ্যায়ীদের সঙ্গে পরামর্শ করে এ ব্যানার থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিই। বৈষম্যবিরোধী ব্যানারের থেকে সরাসরি পদত্যাগ না করলেও এ ব্যানারের সঙ্গে কার্যত সম্পর্ক ছিন্ন করি গত এপ্রিল-মে মাসে। প্ল্যাটফর্ম থেকে Empowering our Fighters নিয়ে কাজে মনোযোগ দিই। বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা ছিল, সেসবে মনোযোগ দিই। অনেকবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম পদত্যাগ করব। একটা পদত্যাগপত্র লিখে আর জমা দিইনি। পারি নাই আসলে। রাজনৈতিকভাবে ভাবলে পদত্যাগ করে আসাটা সব থেকে সহজ। কিন্তু আমি তো মানুষ, অনেক কঠিন, অভ্যুত্থানের কারণে পারি নাই। আমি এই প্ল্যাটফর্মে তো দেশ সংস্কার করতে আসছিলাম। কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি করতে তো আসি নাই এখানে। 

সাবেক মুখপাত্র জানান, জেলা, উপজেলার অনিয়মের খবর আসত শুধু, সাংবাদিকদের কল আসত। আমি পরিষ্কার করে বলেছি যারা এ কমিটিগুলো দিয়েছে তাদের আপনারা কেন জিজ্ঞেস করেন না? যাদের সাইনে কমিটি হচ্ছে তাদের মুখের সামনে মাইক ধরেন না কেন? এই কমিটিগুলো করার সময় আমার কাছে কমপ্লেইন আসলে তো সরাসরি আমি অবজেকশনগুলো জানিয়েছি সাবেক আহ্বায়ক, সদস্য সচিবের কাছে। এনসিপি গঠনের আগে ঢালাওভাবে কমিটি ফর্ম হয়েছে। আমিসহ কয়েকজন এসব কমিটি নিয়ে অবজেকশন দিই। কোনো উত্তর আমাদের দেয়া হয়নি। মুখপাত্র হিসেবে বৈষম্যবিরোধীর পেইজের এক্সেস থাকার কথা আমার কাছে, আমার দায়িত্ব হওয়ার কথা মিডিয়া হ্যান্ডলিং। পেইজের এক্সেস দেয়া তো দূরের কথা এই পেইজ থেকে মার্চ মাসে আমার বিরুদ্ধে পর্যন্ত পোস্ট হয়েছে। আমি ব্যবস্থা নিতে চাইলে পেইজকে আমার বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় আর নইলে Silent treatment সহ্য করতে হয়।

তিনি আরও লিখেছেন, দিনের পর দিন হেন কোনো নোংরামি নাই যা এরা করেনি। জুলাই এর পরে এই পরিস্থিতিগুলো ডিল করতে গিয়ে মার্চ, এপ্রিল মাসে আমি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যাই। যাদের সাথে কাজ করতে চাচ্ছিলাম তারাও হেয়ার রোডেরর আশায় তাকিয়ে থাকত। একদিকে আমার কথার সাথে তাল মেলাত, অন্যদিকে রাতেরবেলা হেয়ার রোডে গিয়ে পদ-পদবি নিয়ে বার্গেইনিং করত, সব খবর আমি পেতাম। আমি কনফ্রন্ট করলে আমাকেও বলা হত যাতে সুপ্রিম অথরিটি সাথে আমি পদ নিয়ে কথা বলে আসি। আমি সরাসরি বলি যে, আমি কেন ওদের কাছে পদ খুঁজতে যাব? ওরা আমাকে পদ দেয়ার কে? ও কোন হনু হয়ে গেছে যে আমাকে এসে তারা পদ দিবে? ওর কাছে গিয়ে পদ আনতে হলে প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করার আর মানে কি? এসবের ভাই-ব্রাদার রাজনীতির যন্ত্রণায় বদ্ধ জলাশয়ের মতো প্ল্যাটফর্ম আটকে ছিল। আমি কাজ করতে চাইলে আমাকে করতে দিবে না। বরং পেছনে কথা ছড়ানো হতো আমি প্ল্যাটফর্মের কাওকে কাজ করতে দিচ্ছি না, কাউন্সিল আটকে রেখেছি। নেতারা তাদের জুনিয়রদের দিয়ে প্রোপাগান্ডা সার্কুলেট করে বিভিন্ন ফোরামে।

পরবর্তীতে আমি সিদ্ধান্ত নিই এভাবে হয় না। নির্বাহীর যারা অবশিষ্ট ছিল তাদের জানিয়ে দিই। মুখপাত্র পরিচয়টা বাদ দিয়ে শিক্ষার্থী পরিচয়টাকে আপন করার শুরু করি। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার জানতে পারি আমি নাকি বৈষম্যের কাউন্সিল আটকে রেখেছি। অথচ সবাই জানে কাউন্সিল মন্ত্রীপাড়ায় আটকে আছে। আর আমি এ প্ল্যাটফর্মের সাথেই নাই। আমি চুপ করে ছিলাম সেটা নিয়েও একটা না একটা প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছিল। আমার এত ক্ষমতা, আমি কমিটি আটকে রেখেছি। অথচ আমি শাখা কমিটি নিয়ে কোনো অ্যাকশন নিতে পারিনি, ঢালাও ভাবে পেইজ থেকে পোস্ট হওয়া উপজেলা কমিটিগুলোও আটকাতে পারিনি। অথচ যখন হেয়ার রোড থেকে আহ্বায়ক সিলেক্ট হলো তখন নির্বাচন হতে ২০ দিনও লাগেনি।

কাউন্সিলে ভোটের বিষয়ে তিনি বলেন, আমি শেষ দিন পর্যন্ত কাউন্সিলে ভোট না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম। যারা কাজ করতে চায় তারা বেশিরভাগ এই কাউন্সিলে প্রার্থীই হওয়ারই সুযোগ পায়নি। ভোটার খুব লিমিটেড, যার মধ্যে একটি রাজনৈতিক দলের লোকজন সব। জুনিয়ররা ক্যাম্পাসে এসে আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে, যাতে ভোটটা দিতে যাই। স্বাভাবিকভাবেই আমি অপারগ ছিলাম। কিন্তু ভোট শেষ হওয়ার ১ মিনিট আগে আমি ভোটটা দিয়ে আসি। এতটুকুই যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি চেষ্টা করছি এখান থেকে ভালো কিছু হোক। আমি ভিতর থেকে চাচ্ছিলাম এই প্ল্যাটফর্মটার অন্তত ভালো কিছু হোক। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম যেভাবে সাপের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে প্ল্যাটফর্মকে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে, এখান থেকে ভালো কিছু অসম্ভব। এ নির্বাচনে কিছু প্রার্থী ছিল যাদের কাজ করার সত্যিকার ইচ্ছা ছিল। আমি ওই সাপোর্টটা দেয়ার চেষ্টা করছি। তবে রাতের বেলা ফলাফলের পর দেখলাম নির্বাচনে অংশ না নেয়া একজন এসে মেম্বার হয়ে গেছে কাউন্সিলের। এসব দেখে আমি অত্যন্ত লজ্জিত। সেই একই স্বেচ্ছাচারিতা, স্ট্যান্ডবাজী, ভাই-ব্রাদার কোরামের খেলা। এখন বোধ করি এই প্ল্যাটফর্মের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

‘অভ্যুত্থানের কথা চিন্তা করে আমি এই প্ল্যাটফর্ম থেকে সকল ধরনের সমর্থন ও কাউন্সিলে প্রদত্ত ভোট প্রত্যাহার করলাম। আমি অত্যন্ত অশান্তিতে আছি। অভ্যুত্থান যেমন স্বপ্ন দেখিয়েছে, গোষ্ঠীস্বার্থে এই প্ল্যাটফর্ম একইভাবে বহু মানুষের স্বপ্ন ও সময় নষ্ট করেছে। আমি অভ্যুত্থানের স্বপ্নকে রক্ষার জন্য এই প্ল্যাটফর্মে গিয়েছিলাম। প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার আগে আমাকে প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল আমি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারব। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের মুখপাত্র হিসেবে যাওয়ার পরেই টের পাই সংস্কার, জুলাই, শহীদ, আহত এসব মুখের বুলিমাত্র। শুধু আমি না, অনেক ছাত্ররাই পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে প্ল্যাটফর্মের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সবার সাথে শুধু ছলনা হয়েছে।  যারা আমাকে কষ্ট দিয়েছে, আমার সাথে নোংরামি করেছে এতগুলা মাস, অভ্যুত্থানকে বাজারদরে কেনা-বেচা করেছে তাদের আমি কখনো ক্ষমা করব না। আমি রুহের ভেতর থেকে বদদোয়া দিচ্ছি এই মোনাফেকদের।’

সবশেষে তিনি লেখেন, রাজনৈতিকভাবে চাইলে অনেক সুবিধা আমি নিতে পারতাম। কিন্তু পারি নাই। আসে নাই ভেতর থেকে। অনেক বেশি মানুষ মারা গেছে আসলে। এতগুলা সন্তান এতিম হইছে, মেয়েরা বিধবা হইছে, বাবা-মা সন্তানহারা হইছে। আমি পারি নাই এসবকে পলিটিক্যালি ক্যাশ করতে। আমি গত ৮-৯ মাসকে ঝেড়ে ফেলে সামনে আগাতে চাই। অনেক ভালো ছেলে-পেলেকে এই প্ল্যাটফর্মে আমি দেখেছি, Goodwill আছে যাদের। আমি পরামর্শ দিব আপনারা সবাই যাতে পড়ার টেবিলে মনোযোগ দেন, কাজে মনোযোগ দেন। আমিও ভেঙে পড়ছি না, গুছিয়ে আনছি সবকিছু। ফি আমানিল্লাহ।