'সেক্সি' ছবি ফেসবুকে, বাজে মন্তব্যের শিকার অভিনেত্রী রাজিনি চ্যান্ডি

প্রকাশ | ১৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৭:২৮

যাযাদি ডেস্ক

ভারতীয় অভিনেত্রী রাজিনি চ্যান্ডি যখন তার গ্ল্যামারাস ফটোশুটের ছবি ফেসবুকে শেয়ার করলেন, তখন বুঝতে পারেননি সেগুলো এ রকম ভাইরাল হবে এবং তিনি অনলাইনে এ রকম বিদ্বেষপূর্ণ আক্রমণের শিকার হবেন।

 

রাজিনি চ্যান্ডির বয়স ৬৯। অভিনেত্রী হওয়ার আগে তিনি ছিলেন গৃহিণী। এই বয়সে তাকে সাধারণত দেখা যায় নানা রঙের চমৎকার সব শাড়িতে। কিন্তু এই ফটোশুটে তিনি পরেছিলেন জাম্পস্যুট, দীর্ঘ পোশাক, জিন্স আর খাটো ডেনিমের একটি পোশাক। কিছু ছবিতে দেখা যাচ্ছে তার মাথায় বাগান থেকে সদ্য তোলা সাদা ফুলের মুকুট।

 

রাজিনি চ্যান্ডির এসব ছবিকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কেরালার সংবাদপত্রে বর্ণনা করা হচ্ছে 'বোল্ড অ্যান্ড বিউটিফুল', অর্থাৎ খুবই সাহসী এবং সুন্দর বলে। তিনি সেখানেই থাকেন। কেরালা এখনো বেশ রক্ষণশীল একটি রাজ্য, সেখানে বেশির ভাগ নারীকে এখনো শাড়ি বা লম্বা স্কার্টের মতো পোশাকেই দেখা যায়।

 

রাজিনি চ্যান্ডি জানান, এই ফটোশুটের আইডিয়া আসলে ২৯ বছর বয়সী ভারতীয় ফটোগ্রাফার আথিরা জয়ের। প্রথাবিরোধী ফটোগ্রাফির জন্য তিনি বেশ পরিচিত।

 

আথিরা জয় বলেন, রাজিনি চ্যান্ডি তার নিজের মায়ের চেয়ে একেবারেই আলাদা এবং সেটাই তাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল তার ছবি তুলতে।

 

তিনি বলেন, ‘ভারতীয় নারীরা তাদের পুরোটা জীবন বিয়ের খাঁচায় আবদ্ধ থেকে সন্তানদের বড় করতে করতে কাটিয়ে দেয়। বয়স ষাট পেরোলেই তারা জীবনের সব কিছু ছেড়ে দেয়। তারা তখন তাদের নাতি-নাতনির দেখাশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’

 

আথিরা জানান, তার ৬৫ বছর বয়সী মা একজন গড়পড়তা ভারতীয় নারীর মতোই। ষাটোর্ধ্ব নারীদের মধ্যে যেসব স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা যায়, সেগুলোর সবই তার আছে।

 

‘কিন্তু রাজিনি একেবারেই আলাদা। তিনি তার শরীরের যত্ন নেন। তিনি শারীরিকভাবে খুবই সুস্থ। তিনি সাহসী, সুন্দর, ফ্যাশনসচেতন। তার বয়স ৬৯, কিন্তু মনের ভেতরে তিনি আসলে এক ২৯ বছরের নারী, ঠিক আমার মতো।’

 

কেরালার সনাতনী সমাজে চ্যান্ডি সব সময় ছিলেন এক ব্যতিক্রমী নারী। তার স্বামী কাজ করতেন মুম্বাইয়ে এক বিদেশি ব্যাংকে, সেই কারণে দীর্ঘদিন মুম্বাইয়ে কেটেছে। ১৯৯৫ সালে তিনি ফিরে এলেন কেরালায়। তিনি যখন জিন্স পরেন, ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে বাইরে যেতেন, তখন লোকে ফিরে ফিরে তাকাত। তিনি জানান, একবার হাতাবিহীন ব্লাউজ পরায় তাকে রাস্তায় ভর্ৎসনা করা হয়েছিল।

 

গত কয়েক বছরে তিনি যেসব প্রথাবিরোধী কাজ করেছেন, তার জন্য বারবার গণমাধ্যমে সংবাদ হয়েছেন। যেমন ২০১৬ সালে তিনি ৬৫ বছর বয়সে মালয়ালাম ভাষার একটি কমেডি নাটক, 'ওরু মুথাসি গাডহা‌'য় (দাদির গদা) অভিনয় করেন। তারপর তিনি আরো দুটি ফিল্মে অভিনয় করেছেন। গত বছর অংশ নিয়েছেন 'বিগ ব্রাদারের' মালয়ালি সংস্করণ 'বিগ বসে'।

 

চ্যান্ডি বলেন, তিনি এই ফটোশুটে অংশ নেন বয়স্ক মানুষদের অনুপ্রাণিত করতে, যাতে তারা বিশ্বাস করতে পারে যে এখনো তাদের পক্ষে জীবনকে উপভোগ করা সম্ভব।

 

‘বেশির ভাগ তরুণ দম্পতি তাদের সন্তানদের বড় করার পেছনে তাদের সময় ব্যয় করে। তারা নিজেদের সাধ-আহ্লাদকে পেছনে ঠেলে রাখে। তারপর তারা উপলব্ধি করে যে নিজেদের জীবনের স্বপ্ন পূরণের মতো বয়স আর তাদের নেই। তারা ভাবে, এই বয়সে এসব করলে সমাজ কী ভাববে। আমি বিশ্বাস করি, আপনি আপনার যা ইচ্ছা করতে পারেন‍, কাউকে আঘাত না করলেই হলো।’

 

‘আমি আমার পরিবার এবং আমার সমাজের সব দায়িত্ব পালন করেছি। এখন আমি তাই করছি, যা থেকে আমি আনন্দ পাই। আমি ড্রাম বাজানো শিখছি, আমি যে একেবারে ঠিকঠাকমতো সব করতে পারব তা নয়, কিন্তু আমি এটা করছি আমার আনন্দের জন্য।’

 

এই ফটোশুটটাও তিনি করেছিলেন নিজের আনন্দের জন্য।

 

‘ডিসেম্বর মাসে আথিরা আমাকে জিজ্ঞেস করল, আমি একটা ফটোশুট করতে রাজি কি না এবং পশ্চিমা পোশাক পরার ব্যাপারে আমার কোনো ধরনের বাধা আছে কি না। আমি বললাম- না, আমি তো আগে সব সময় পশ্চিমা পোশাক পরতাম, যখন বয়স কম ছিল। আমি তাকে বললাম, আমার তো সাঁতারের পোশাকে ছবিও আছে।’ বলছিলেন চ্যান্ডি।

 

আথিরার প্রস্তাব তার কাছে বেশ মজার বলে মনে হলো। তিনি যখন বিদেশে বেড়াতে যেতেন, তখন প্রবীণ নারীদের সেজেগুজে বাইরে যেতে দেখে তার ভালো লাগত।

 

‘তবে আমি তাকে বললাম, আমার স্বামী যদি রাজি হয় তাহলে আমি এটা করব। তখন ও আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করল। আমার স্বামী বলল, এটা তো ওর জীবন। ও যদি এটা করতে চায়, আমার তো কোনো অসুবিধা নেই।’

 

চ্যান্ডি বলেন, তার জন্য আথিরা স্থানীয় একটি বুটিক থেকে যেসব পোশাক এনেছিল, সেগুলো যখন তিনি প্রথম দেখলেন, তখন একটু ধাক্কা খেয়েছিলেন।

 

‘এ রকম সেক্সি পোশাক আমি বহুদিন পরিনি। কিন্তু যখন আমি এগুলো পরলাম, আমার মনে হলো, ঠিকই আছে।’

 

গত মাসের শেষের দিকে কোচি শহরে চ্যান্ডির বিশাল বাড়িতে এই ২০টি ছবি তোলা হয়। গত সপ্তাহে যখন এসব ছবি ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামে আপলোড করা হলো, তারপর যেন ঝড় উঠল, প্রশংসা এবং নিন্দা, দুটোই সমানতালে আসতে লাগল। বিষয়টি নজরে এলো স্থানীয় সংবাদপত্রের।

 

হাজার হাজার মানুষ প্রশংসা করে মন্তব্য করেছে। অনেকে বলেছে, 'আপনি প্রমাণ করেছেন বয়স আসলে একটি সংখ্যা মাত্র।' অনেকেই তাকে 'সাহসী', 'অদ্ভুত সুন্দর', 'কামোদ্দীপক' বলে বর্ণনা করেছেন। তার 'আত্মবিশ্বাসের' প্রশংসা করেছেন।

 

অনেকে তার ফোন নম্বর খুঁজে বের করে ফোন করেছেন, হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ দিয়ে বলেছেন, 'আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে আন্টি।'

 

কিন্তু প্রশংসার পর শুরু হলো তীব্র নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া।

 

‘আমাকে বেশ্যা বলে ডাকা হলো। একজন বলল, এখনো তোমার মরণ হয়নি? আরেকজন উপদেশ দিলেন, আমার উচিত এখন ঘরে বসে বাইবেল পড়া। বললেন, এখন তোমার শরীর দেখানোর বয়স নয়, ঘরে বসে প্রার্থনা করার সময়। আরেকজন তো বলল, আমি একটা পুরোনো অটোরিকশা, এটাতে যতই আরেক পোচ রং লাগাই, এটি পুরোনোই থেকে যাবে।’

 

অনলাইনে যারা এটা নিয়ে নিন্দার ঝড় তুলছিল, তারা দুটি ছবি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উত্তেজিত ছিল। একটিতে চ্যান্ডিকে দেখা যাচ্ছে ছেঁড়া জিন্স পরা অবস্থায়, তিনি দুই পা ফাঁক করে বসে আছেন। তার বুকের খাঁজ কিছুটা দেখা যাচ্ছে। দ্বিতীয় ছবিতে তিনি ডেনিমের একটি খাটো পোশাক পরে আছেন।

 

 ‘এই ছবিটা নাকি আরো খারাপ, কারণ এতে আমার পা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমার পা সুন্দর, কাজেই এটা নিয়ে আমার মোটেই মাথাব্যথা নেই।’ হেসে বললেন তিনি।

 

তবে একটু পরে তিনি স্বীকার করলেন, যে রকম অনবরত অনলাইনে তাকে ট্রল করা হচ্ছে, যেভাবে নেতিবাচক মন্তব্য করা হচ্ছে, এটা তার মনের ওপর প্রভাব ফেলছে। আর মেয়েরাই যেন বেশি করে তার নিন্দায় উঠে-পড়ে লেগেছে।

 

‘বৃদ্ধা নারীর মধ্যে যৌন আবেদনকে অনেক পুরুষই আপত্তিকর বলে মনে করে। তারা এই বয়সের নারীকে কামনার বস্তু বলে ভাবতে চায় না। কিন্তু যেটা আমাকে আশ্চর্য করেছে, তা হলো- বেশির ভাগ নেতিবাচক মন্তব্য আসলে করেছে মেয়েরাই।’ বলেছেন তিনি।

 

‘আমার মনে হয়, এর পেছনে আছে ঈর্ষা। যে নারীদের বয়স ৪০ বা ৫০-এর কোঠায়, তারা নিজেদের যত্ন নেয় না, কাজেই তাদের চেয়ে বেশি বয়সী কোনো নারীকে যখন তার সৌন্দর্য প্রকাশ করতে দেখে, সেটা তারা নিতে পারে না।’

 

নমিতা ভান্ডারে আর্টিকল ফোরটিন নামের একটি নিউজ ওয়েবসাইটের জেন্ডার বিষয়ক সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘এর কারণ হয়তো ঈর্ষা; কিন্তু মনে রাখতে হবে, সব নারী নারীবাদী নয়।’

 

‘আমাদের মায়েরা আর দাদি-নানিরাই কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছেন।’

 

তিনি বলেন, বিশ্বজুড়েই নারীদের যখন বয়স বাড়ে, তখন তারা একই সঙ্গে দুই ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়, একদিকে সেক্সিজম বা লিঙ্গবৈষম্য, আরেকদিকে প্রবীণদের প্রতি বৈষম্য।’ তবে তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশের মতো এখানে প্রবীণ নারীদের একেবারে অদৃশ্য করে দেওয়া হয় না।

 

‘আমার মনে হয়, প্রবীণদের প্রতি বৈষম্য ভারতে কিছুটা হয়তো নারীদের পক্ষেই কাজ করে। বয়স্ক নারী, যেমন আমাদের দাদি-নানিরা পরিবারে একটি বিশেষ মর্যাদা পান। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও তো সত্যি, আমরা তাদের মর্যাদা দিই, কারণ তারা একটা সনাতনী ধাঁচের মধ্যে থাকেন বলেই। তারা পোশাক পরেন সনাতনী নিয়মে শালীনভাবে, যদি বিধবা হন, তাহলে সাদা কাপড় পরেন, এবং তাদেরকে যৌনতার দৃষ্টিতে মোটেই দেখা হয় না।’

 

‘এখন একজন দাদি বা নানি যদি তার স্তনের খাঁজ দেখান, নিজের পা দেখান, তিনি তো এই স্টিরিওটাইপ বা সনাতনী ধাঁচ একেবারে উল্টে দিচ্ছেন। তিনি যেন তার সীমারেখা অতিক্রম করছেন। তখন তাকে আক্রমণে কেউ আর বাধা দেখছে না।’

 

চ্যান্ডি বলছেন, তিনি কখনো ভাবেননি তার ছবি এভাবে ভাইরাল হবে এবং তাকে অনলাইনে এ রকম ট্রলের শিকার হতে হবে।

 

‘আমি আসলে খুবই স্পষ্টবাদী, হয়তো ওই কারণে অনেক মানুষ আমাকে পছন্দ করে না। কিন্তু আমি তাদেরকে বলি যে আমার পেছনে সময় নষ্ট না করে আপনারা দেশের জন্য, বিশ্বের জন্য, এই পৃথিবীর প্রকৃতির জন্য ভালো কিছু করতে চেষ্টা চালান না কেন?’ সূত্র : বিবিসি

 

যাযাদি /এমডি