ঈশ্বর কি তোমার আমার মিলন লিখতে পারতো না...
প্রকাশ | ৩১ জুলাই ২০২৩, ০৯:৪৭

ঢাকাই সিনেমার মূল প্রাণই থাকে গানের মধ্যে। যে প্লে-ব্যাক যত বেশি শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে, সিনেমাটিও প্রেক্ষাগৃহে চালু থেকেছে সপ্তাহের পর সপ্তাহজুড়ে তত বেশি। এমন সুসময়টা বহু আগেই গত হয়ে গিয়েছিল। প্লে-ব্যাকের জায়গা দখল করে নিয়েছিল হিন্দি সিনেমার আদলে তৈরি আইটেম সং। কিন্তু ঢাকাই পরিচালকরা ভুলে গিয়েছিলেন এই দেশ হিন্দুস্তান না- বাংলাদেশ। এ দেশের দর্শক তার নিজস্ব সংস্কৃতিতেই চলে। ধার করা সংস্কৃতিতে চলে না।
এটা বুঝেও পরিচালক বা নির্মাতারা আইটেম গান দিয়ে সিনেমায় লগ্নি করা টাকা উসুল করার চেষ্টা করেছিলেন। সফলকাম হননি। পরে বুঝেছেন এটা সামান্থা রুথ, হেলেন, ক্যাটরিনা, মালাইকা, নাতালিয়া বা আলিয়া ভাটদের দেশ নয়। ফলে ওদের মতো করে ব্যর্থ অনুসরণের এমন সময়ের কিছু আইটেম গানের ধরনেও পরিষ্কার হয়ে যায় কতটা নিচে নেমে গিয়েছিলেন এই সময়ের পরিচালকরা : ‘ওরে পাকনা চেয়ে দেখনা আমি আইসক্রিম, চাইলে পাবি আইলে খাবি দেখবি নাইস ড্রিম, কিংবা ‘আয় না দু’জনে মিলে ওয়ান টু খেলি, মুন্নী শিলা নই আমি চামেলি’, অথবা ‘আমি দেখতে লালে লাল, রূপে গোল মরিচের ঝাল’ ও ‘ফূর্তি ফূর্ত আজ, ফূর্তি সারা রাত, বাকি সব যা কিছু, যাক গোল্লায় যাক’।
দেশীয় সিনেমার গানে যে রোমান্টিক, শ্রুতিমধুর আর অর্থবহ গানের কথা ছিল এদের জন্যই সেসব গান হারিয়ে গিয়েছিল এই হিপ-হপ, আইটেম গান আর ইলেক্ট্রনিক ড্যান্স মিউজিকের দৌরাত্ম্যে।
যদিও তাদের গান কখনোই মানুষের মুখে মুখে ফেরেনি। মানুষ শুনলেও শ্রোতাপ্রিয়তা পায়নি। পর্দায় আইটেম গার্লের নাচুনি-কুদনি দর্শক দেখলেও ওই নাচুনি-কুদনি পর্যন্তই ছিল তার বিনোদনের পরিসীমা। একপর্যায়ে অবস্থা এমন হয়েছে, প্রযোজকদেরও ভরসা ছিল না নির্দেশকদের ওপর। নির্দেশকদের আস্থা ছিল না সঙ্গীত পরিচালকদের ওপর। আর সঙ্গীত পরিচালকদেরও আস্থা ছিল না শিল্পীদের ওপর। এই কারণেই প্লে-ব্যাকের ক্ষেত্রে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি এমন একটা খারাপ সময় পার করে।
ফলে এখানে আইটেম সং কখনোই গুরুত্ব তৈরি করতে পারেনি এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এই ধারাটি মুখ থুবড়ে পড়ে। ক্ষণিকের জন্য ঝলক দেখানোর চেষ্টা করলেও মুখ থুবড়ে পড়ে সেই নায়লা নাঈম, জ্যাকলিন মিথিলা, নাসরীন, শায়লা, ময়ূরী এবং সর্বশেষ ইয়ামিন হক ববি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবাই আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। এটা সম্ভব হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের কিছু মেধাবী তরুণ, শিক্ষিত ও রুচিশীল পরিচালকদের কারণেই মূলত।
সিনিয়র পরিচালকরা যেখানে ওইসব আইটেম গার্ল দিয়ে বাংলা প্লে-ব্যাককে কলুষিত করেছেন, সেখানে এই নতুন এক ঝাঁক রুচিশীল শিক্ষিত তরুণরা এখন আবার বাংলা প্লে-ব্যাককে স্বমূর্তিতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় আছেন। গিয়াস উদ্দিন সেলিম, অমিতাভ রেজা, মেজাবাউর রহমান সুমন, রায়হান রাফী, চয়নিকা চৌধুরীসহ আরও অনেকে।
তাদের হাত ধরেই এখন আবার ঢাকাই প্লে-ব্যাকের মন্দাভাব কাটতে শুরু করেছে। আবার প্লে-ব্যাক মানুষের মুখে মুখে ফিরতে শুরু করেছে। আগের মতো দীর্ঘমেয়াদি না হলেও একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতে শুরু করেছে। গানে সুন্দর মেলোডিও আসছে ফিরে। কথাগুলোও এখন রাফ অ্যান্ড টাফ হচ্ছে না। গানের মতোই নমনীয় ও সুরেলা। এবারে ঈদে মুক্তি পায় চয়নিকা চৌধুরীর ‘প্রহেলিকা’ সিনেমা। সিনেমাটি মুক্তির আগেই সাড়া ফেলে দিয়েছিল তার প্রথম গানটি : ‘মেঘের নৌকা, তোমায় ওড়াবো আকাশে, সাগরের শঙ্খ তুমি, তোমায় বাজাবো বাতাসে’- ইমরান ও কোনালের কণ্ঠে দ্বৈত সুরে গাওয়া এই গানটি ছিল এবারের অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। যারা বলতেন, রোমান্টিক গানের দিন শেষ, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল গানের মতো গান বাঁধতে জানলে এখনো সমান জনপ্রিয়তার সঙ্গে চালু থাকতে পারে রোমান্টিক গান। সেটা এই ‘মেঘের নৌকা’ গানটি দিয়েই প্রমাণিত হয়েছে।
এখন তো এমন হয়েছে যে, সিনেমা মুক্তি দেওয়ার আগেই তার গানের মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। কারণ, একটাই গান যদি জনপ্রিয় হয়, তাহলে সিনেমার দর্শক আপনা আপনিই হবে এমন ভরসা পাওয়া। এ থেকেও বোঝা যায়, একটি ভালো গান সিনেমার দর্শকপ্রিয়তার জন্যও কত গুরুত্বপূর্ণ।
এর আগে সে রকম শ্রোতাপ্রিয় গান ‘হাওয়া’ সিনেমার ‘সাদা সাদা কালা কালা’ কিংবা ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ গান দুটোও সিনেমাটিকে জনপ্রিয় করতে বিপুল দর্শক টানতে সক্ষম হয়েছে।
এই গানগুলোর প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বোঝা যাচ্ছে, ঢাকাই সিনেমার গানেও একটা সুদিন ফিরতে শুরু করেছে। এক সময়ের ধারাবাহিক জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান, বশির আহমেদ, আবদুল আলিম, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, আবদুল জব্বার, খুরশীদ আলম, সৈয়দ আবদুল হাদী, শাহনাজ রহমত্ল্লুাহ, সাবিনা ইয়াসমীন, রুনা লায়লাদের মতো শিল্পীই আর উঠে আসতে পারছিল না ঢাকাই প্লে-ব্যাকে। সেই আলাউদ্দিন আলী, ইমতিয়াজ বুলবুল, সুবল দাসদের মতো সুরকারও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না আর। কারণ, একটাই আইটেম গানের মতো অত্যন্ত দুর্বল ও মুখরোচক চটুল গান।
এখন প্লে-ব্যাকের মধ্য দিয়ে নতুন শিল্পীও উঠে আসার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ইতোমধ্যে সোমনূর মনির কোনাল তার কণ্ঠসুধা দিয়ে তেমন একটা জাদু তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি এবারের ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত একাধিক গানে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। ‘প্রহেলিকা’ ছাড়াও শাকিব খানের ‘প্রিয়তমা’ সিনেমার ‘তোমাকে জানিয়ে দিলাম ও প্রিয়তমা’ নামের প্রধান গানটিতেও দ্বৈত শিল্পীর একজন হিসেবে কণ্ঠ দিয়ে শ্রোতাপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। জনপ্রিয় হয়েছে এই গানটিও। একই সিনেমার আরেকটি গান ‘ঈশ্বর’ও ছিল এবারের আরেকটি শ্রোতাপ্রিয় গান।
তবে অন্যান্য সিনেমা কমবেশি আলোচিত হলেও গান ততটা আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি, যতটা করেছে ‘প্রহেলিকা’ ও ‘প্রিয়তমা’ সিনেমা দুটোর গান। চয়নিকা চৌধুরী তো তার প্রথম পরিচালিত সিনেমা ‘বিশ্বসুন্দরী’তেও জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছিলেন।
এক সময় দর্শকের অভাবে প্রেক্ষাগৃহগুলোতে প্রায়শই নাইট শো বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন মালিকপক্ষ। এমন প্রেক্ষাপটে এ রকম গান দিয়ে যদি আবার ঢাকাই সিনেমার সুদিন ফেরানো সম্ভব হয় তখন দেখা যাবে আবার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে নিয়মিত নাইট শোও চলছে।
যাযাদি/ এস