অনন্য প্রতিভায় ফজলুর রহমান বাবু
প্রকাশ | ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ১১:৩১

দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের সব ধারায় সমান বিচরণ করা সফল ব্যক্তিত্বে ফজলুর রহমান বাবু। মঞ্চের পাশাপাশি অসংখ্য টিভি নাটক টেলিফিল্ম, বিজ্ঞাপন ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে একজন প্রাজ্ঞ শিল্পী হিসেবে নিজেকে অসংখ্যবার প্রমাণ করেছেন । তিন যুগেরও অধিক সময় ধরে সব বয়সি অভিনেতাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সমানতালে অভিনয় ও সঙ্গীতচর্চা করে চলেছেন বাবু। একাধারে তিনি অভিনয়শিল্পী এবং সঙ্গীতশিল্পী। দুইটি মাধ্যমেই তিনি সমান জনপ্রিয়। শিল্পী জীবনের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন নানা সম্মাননা ও পুরস্কার।
ফজলুর রহমান বাবুকে বলা হয় জাত শিল্পী। সেটা অভিনয় কিংবা গান। বিশেষ করে ইন্দুবালা’ শিরোনামের গানটি যিনি শুনেছেন, কিংবা ‘অজ্ঞাতনামা’ সিনেমার সেই প্রবাসীর বাবার চরিত্রের অভিনেতা হিসেবে যারা তাকে দেখেছেন তারা জানেন একজন বাবুকে কতটা জাত অভিনেতা বা শিল্পী বললেও কম বলা হয়। কিংবা হালের ‘দায়’ অথবা ‘এক্সট্রা আর্টিস্ট;’ নাটকের একজন মানবিক মানুষের হাহাকার তার অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি জীবন্ত করে তুলেছেন। যেটা বাবুর ক্ষেত্রে সম্ভব। এছাড়া ‘নুরু মিয়া এবং তার বিউটি ড্রাইভার’ সিনেমায় ভিক্ষুক কিংবা ‘স্বপ্নজাল’ সিনেমায় খল চরিত্রেও তিনি তার শক্তিমান অভিনয়শিল্পী হিসেবে দারুণভাবে সফলতার প্রমাণ দিয়েছেন। যে কোনো চরিত্রে তার অভিনয় দেখে সব শ্রেণিপেশার মানুষ মুগ্ধ হোন। এতটা সাবলীল এবং প্রাণবন্ত ও প্রাণোচ্ছল অভিনয়শিল্পী আমাদের দেশে খুব কমই আছেন। বাবু তার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আদর্শ এবং অনুপ্রেরণার প্রতীক। মঞ্চ টিভি নাটক এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে ভূমিকা রেখে চলেছেন ফজলুর রহমান বাবু। তিনি পর্দায় বা মঞ্চে আসা মানেই আলাদা রকমের এক চরিত্রের দেখা পান দর্শক। বিশেষ করে মানবিক এবং জীবনঘনিষ্ঠ চরিত্রগুলোতে বাবু নিজেকে মানিয়ে নেন অনায়াসেই। তাইতো বাবু মানেই ভালো লাগার একটি চরিত্র। একজন ভালো ও জাত শিল্পী ফজলুর রহমান বাবু। বাবু এমন একজন শিল্পী যার বিকল্প তৈরি হয়নি।
নিজের অভিনয় প্রসঙ্গে বাবু বলেন, আমি তো একজন অভিনেতাই হতে চেয়েছিলাম। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে, অভিনয় করে যেতে পারছি।
বাংলাদেশে খুব কম মানুষই আছে, যারা নিজেদের পছন্দের কাজটিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারেন। আমার সবচেয়ে পছন্দের কাজ হচ্ছে অভিনয় করা। আমি পেশায় একজন ব্যাংকার ছিলাম। তবে আমি অভিনয় পেশাটাকে বেছে নিয়েছি এবং খুব উপভোগ করি। ছাত্রজীবন থেকেই অভিনয়টা এনজয় করি। তিনি বলেন, অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমি মাধ্যম বিবেচনা করি না। যেখানেই অভিনয় আছে, সেখানেই অভিনয় করি। সব মাধ্যমেই অভিনয় এনজয় করি। স্বাচ্ছন্দ্য নয় বরং উপভোগ করি। টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, ওটিটি, ইউটিউব ছাড়াও আমি রেডিওতে নিয়মিত অভিনয় করি। প্রতি সপ্তাহেই আমার নাটক রেডিওতে প্রচার হয়। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হচ্ছে মঞ্চ। কারণ মঞ্চেই আমার অভিনয়ের জন্ম। আমি একজন অভিনেতা। আরো কিছুদিন অভিনয় করতে চাই। কারণ অভিনয়কে এখনো আমি ভালোবাসি। অভিনয় এখনো আমাকে টানে. তাই সব ধরনের চরিত্রে কাজ করতে চাই।
আজীবন মানুষের ভালোবাসা পেতে চাই। গান গাওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শৈশব থেকেই আমি প্রচুর গান শুনতাম। গানের প্রতি ভালোলাগা থেকেই গুনগুন করে গান তুলতাম এবং বন্ধুদের শোনাতাম। তবে আমার গান শেখা হয়নি। অভিনয়ে এসে বুঝতে পারলাম অভিনয়ের সঙ্গে গানের একটি গভীর স¤পর্ক রয়েছে। একজন ভালো ও পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা হতে হলে গান, নাচ, পেইন্টিংসহ সবই জানতে হয়। আমি সব সময় চেষ্টা করি সেরাটা দেওয়ার।
ফজলুর রহমান বাবু ১৯৬০ সালের ২২ আগস্ট ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানেই তার শৈশব ও কৈশরের বেশির ভাগ সময় কাটে। স্কুলে পড়া অবস্থায় মঞ্চনাটক তাকে আকৃষ্ট করে। ক্রমে ঝোঁক বাড়তে থাকে মঞ্চনাটকের প্রতি। এইচএসসি পরীক্ষার পর ১৯৭৮ সালে ফরিদপুরে টাউন থিয়েটারের হয়ে ‘তালেব মাস্টারের হালখাতা’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর বৈশাখী নাট্যগোষ্ঠীতে যোগ দেন তিনি। একই বছর বাবু প্রথমবারের মতো জাতীয় নাট্য উৎসবে অভিনয় করেন। তিনি ১৯৮৩ সালে অগ্রণী ব্যাংকে যোগদান করেন এবং তার কর্মস্থল ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ঢাকায় চলে আসার পর তিনি মামুনুর রশীদের আরণ্যক নাট্যদলে দলে যোগ দেন। এই দলের হয়ে তিনি ‘নানকার পালা’, ‘পাথার’, ‘জয় জয়ন্তী এবং ‘ময়ূর সিংহাসন’ প্রভৃতি নাটকে অভিনয় করে সুনাম অর্জন করেন।
মঞ্চ নাটকে অভিনয় সূত্রে ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত শিল্পী হন বাবু। ১৯৯১ সালে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন বাবু। তার অভিনীত প্রথম টেলিভিশন সোপ অপেরা হলো ‘মৃত্যুক্ষুধা’। কাজী নজরুল ইসলামের রচিত ‘মৃত্যুক্ষুধা’ অবলম্বনে নির্মিত নাটকটি পরিচালনা করেন আবু জাফর সিদ্দিকী। নাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার হয়। এছাড়া তিনি মামুনুর রশীদের ‘ইতিকথা’, ‘সুন্দরী’ ও ‘দানব’ নাটকে গম্ভীর চরিত্রে অভিনয় করেন। ২০০০ এবং ২০০১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বাবু প্রথম আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে কাজ করেন, ‘বিহঙ্গ’ মঞ্চ নাটকে। এছাড়া বাবু তৌকির আহমেদ পরিচালিত ‘দারুচিনি দ্বীপ’ (২০০৭) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এই সিনেমার গল্পকার, সংলাপ রচয়িতা ও চিত্রনাট্যকার হলেন হুমায়ূন আহমেদ।
‘মনপুরা’ সিনেমায় দুইটি গান গাওয়ার মাধ্যমে সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন বাবু। বাবু তার প্রথম একক সঙ্গীত অ্যালবাম ‘ইন্দুবালা’ (২০০৯)। এছাড়া তিনি মিশ্র সঙ্গীত অ্যালবাম ‘মনচোর’ (২০০৮) এর চারটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন।
২০০৪ সালে ‘শঙ্খনাদ’ চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা হিসেবে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন ফজলুর রহমান বাবু । এছাড়া ২০১৬ সালে ‘মেয়েটি এখন কেথায় যাবে’, ২০১৬ সালে ‘অজ্ঞাতনামা’, ২০১৭ সালে ‘গহীন বালুচর’, ২০১৯ সালে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ এবং ২০২১ সালে ‘নোনা জলের কাব্য’ চলচ্চিত্র অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি টিভি নাটক, ওয়েবফিল্মসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অভিনয়ের স্বীকৃতিস্বরূপ মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার, আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডস, চ্যানেল আই ডিজিটাল মিডিয়া পুরস্কারসহ অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এই বয়সে এসেও সমানতাল তার অভিনয়শিল্পের দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছেন বাবু। কাজ করছেন প্রায় সব মাধ্যমেই।
যাযাদি/ এস