সাতক্ষীরার গ্রামবাংলা থেকে বিলুপ্তির পথে লাঙল, জোয়াল আর মই

প্রকাশ | ০৯ জানুয়ারি ২০২১, ১৯:৩৪

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি

বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এদেশে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ লোক কৃষিকাজ করেন। কৃষিকাজে কামারের তৈরি এক টুকরো লোহার ফাল আর কাঠমিস্ত্রির হাতে তৈরি কাঠের লাঙল, জোয়াল, খিল, শক্ত দড়ি আর নিজেদের বাঁশের তৈরি মই ব্যবহার করে জমি চাষাবাদ করতেন আগেকার দিনের গ্রামবাংলার কৃষকরা।

 

কৃষিকাজে ব্যবহৃত এসব স্বল্প মূল্যের কৃষি উপকরণ এবং গরু দিয়ে হালচাষ করে তারা যুগের পর যুগ ধরে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হয়, অন্যদিকে কৃষকের অর্থ ব্যয় কম হয়। ফসলের পাশের কিংবা ঘাসপূর্ণ জমিতে হাল চাষের সময় গরু যাতে কোনো খাদ্য খেতে না পারে,  সেদিক লক্ষ  রেখে পাট,  বেত, বাঁশের কঞ্চি অথবা লতাজাতীয় এক ধরনের গাছ দিয়ে তৈরি  গোমাই, তুরি (অনেকে ঠুসি নামে  চেনেন) গরুর মুখে বেঁধে দেওয়া হয়।

 

আর তাড়াতাড়ি হাল চালানোর জন্য ব্যবহার করেন বাঁশের বা শক্ত  কোনো লাঠি দিয়ে তৈরি পাচইনি (লাঠি)। এটি খুব বেশি দিনের কথা নয়, কয়েক বছর আগে এসব গরুর হালে লাঙল-জোয়াল আর মই গ্রামবাংলার বিভিন্ন জমিতে হরহামেশাই  দেখা যেত। চাষিদের অনেকে নিজের জমিতে হালচাষ করার পাশাপাশি অন্যের জমি চাষিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু অর্থও উপার্জন করতেন।

 

তারা হাজারও কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কখনো কখনো ফুরফুরে আনন্দে মনের সুখে ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতি ও ভাটিয়ালী গান  গেয়ে  গেয়ে জমিতে চাষ দিতেন। এখন হাতে  গোনা দু-একজন কৃষককে এমনভাবে চাষ করতে  দেখা যায়। আর চাষ কাজের জন্য হালের গরু ছোট থাকা কালীন পোষ মানাতে বেশ কিছুদিন সময় লাগত। ভোররাত  থেকে শুরু করে প্রায় দুপুর পর্যন্ত জমিতে হালচাষ করতেন তারা।

 

চাষিরা জমিতে হাল নিয়ে আসার আগে চিড়া-গুড় অথবা মুড়িমুড়কি দিয়ে হালকা জল খাবার  খেয়ে নিতেন। তবে হুকা ও পাতা বা কাগজের তৈরি বিড়ি খাওয়া তাদের অভ্যাসে পরিণত ছিল বলে মনে করেন অনেকে। আবার একটানা হট হট, ডাই ডাই, বাঁই বাঁই, বস বস আর উঠ উঠ করে যখন ক্লান্তি আসত, খানিকটা সূর্য উঠলে চাষিরা সকালের নাস্তার জন্য হালচাষে বিরতি রেখে জমির আইলের ওপর বসতেন।

 

তাদের নাস্তার ধরনটাও ছিল ঐতিহ্যবাহী। এক থালা পানতা ভাতের সঙ্গে কাঁচা অথবা শুকনো মরিচ, সরিষার খাঁটি তেল আর আলু ভর্তা। এসব  তো  গেল শুকনা মৌসুমে হালচাষের কথা। বর্ষাকালে কারো জমির চাষাবাদ পিছিয়ে গেলে সবার শেষে হাল চাষিরা নিজে থেকে হাল গরু নিয়ে এসে পিছিয়ে পড়া চাষিদের জমি চাষ দিতেন।

 

হাল চাষিদের সঙ্গে আরও যোগ দিতেন ধানের চারা লাগার  লোকজন। সবার অংশগ্রহণে উৎসবমুখর এই কাজটিকে বলা হতো-‘কৃষাণ’। কৃষাণে অংশ  নেওয়া কৃষাণদের জন্য জমিওয়ালা গেরস্তরা বড় বড় মোরগ, হাঁস কিংবা খাসি জবাই করে  ভোজ করাতেন।

 

কিন্তু আজকাল সময়ের আবর্তে অনেক গ্রামে এসব গরুর হাল, কৃষি উপকরণ কাঠের লাঙল,  জোয়াল, বাঁশের মই হারিয়ে যেতে বসেছে এবং হাল-কৃষাণ প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা আর অভাবময় জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া দিতে আবির্ভূত হয়েছে দামি দামি যান্ত্রিক হাল যেমন- কলের লাঙল, ট্রাক্টর। সঙ্গে এসেছে ফসলের বীজ বপন-রোপণ, ঝাড়াই-মাড়াই করার যন্ত্র। আর এসব যন্ত্র চালাতে মাত্র দু-এক জন লোক প্রয়োজন। ফলে বিত্তবান কৃষকরা ওই যন্ত্র কিনে মজুরের ভূমিকায় কাজ করলেও গ্রামের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দিনমজুরের জীবন থেকে ওইসব ঐতিহ্যময় স্মরণীয় দিন চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।

 

আগামী প্রজন্ম হয়তো জানতেই পারবে না লাঙল-জোয়াল মই দিয়ে অতীতে চাষকাজ করা হতো।

 

যাযাদি/এস