শিল্পবর্জ্যে দূষিত সুতাং নদী, বেলার নোটিশ

প্রকাশ | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২০:৩২ | আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ২০:৪২

হবিগঞ্জ প্রতিনিধি

 

একটা সময় ছিল যখন বড় বড় নৌকা পাল তুলে উড়ে যেত হবিগঞ্জের লাখাইয়ে অবস্থিত সুতাং নদী দিয়ে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেই দৃশ্য এখন আর দেখা যায় না। নদীর আঁকাবাঁকা পথ যেন এখন মৃতপ্রায়। উজান থেকে নেমে আসা শিল্পকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে এক সময়ের খরস্রোতা সুতাং এখন লাখাইবাসীর দুঃখ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লোকমুখে শোনা যেত সুতাং নদীতে ধরা পড়া বড় বড় মাছের গল্প। কিন্তু সেই গল্প এখন কেবলই গল্প। বাস্তবে নেই ছিটাফোঁটাও। নদীতে ক্রমাগত বর্জ্য পড়ার কারণে পানি চিটা হয়ে কালো রং ধারণ করে অনেকটা তারতেলের মতো হয়ে গেছে। আর এতে করে অস্তিত্ব বিলীনের পথে রয়েছে এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী এই নদীটি। তাই নদীটির হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন নদীপাড়ে বসবাস করা হাজারও ভুক্তভোগী।

 

সুতাং নদীটি বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এর দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৬ মিটার এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার। সুতাং নদী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করে জেলার চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর লাখাই উপজেলা দিয়ে কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়।

 

সরেজমিন দেখা যায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে অলিপুর এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক কলকারখানা। কারখানাগুলোতে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) ব্যবহার করার কথা থাকলেও বেশির ভাগ কারখানায়ই তা মানছেন না। আবার যে কয়েকটি কারখানায় ইটিপি রয়েছে তা নামে মাত্র। অতিরিক্ত খরচের ভয়ে নিয়মিত চালানো হচ্ছে না ইটিপি। ফলে পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনকে রীতিমতো বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে তারা। কারখানাগুলোর ক্রমাগত বর্জ্যই এখন কাল হয়েছে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের।

 

কৃষকরা জানান, সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে লাখাই উপজেলার প্রায় ১০ হাজার হেক্টর বোরো জমি চাষাবাদ করা হয়। কিন্তু এখন নদীর পানি ব্যবহার তো দূরের কথা নদীর পাড়েও যাওয়া যায় না দুর্গন্ধের কারণে। গরু, ছাগল, হাস মুরগি নদীর পানিতে নামলে মারা যাচ্ছে। মানুষের শরীরে লাগলে হচ্ছে চর্ম রোগ। এমতাবস্থায় সীমাহীন ভোগান্তিতে রয়েছেন তারা। এছাড়াও বোরো জমিগুলো চাষ করতে এখন নিতে হচ্ছে বিকল্প ব্যবস্থা। গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলন করে চাষ করতে হচ্ছে জমি। ফলে বাড়ছে কৃষকদের বাড়তি খরচ।

 

স্থানীয় বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম জানান, একসময় সুতাং নদীর বেশ ঐতিহ্য ছিল। কিন্তু এখন নদীর পাড় দিয়ে কেউ হেঁটেও যেতে চায় না। হেঁটে গেলেও নাক-মুখে রুমাল দিয়ে যায়। নদীটির পানির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে পানি কালো বর্ণ ধারণ করে তারতেলের মতো হয়ে গেছে। তাই এ পানি এখন কৃষিকাজেও ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে বিকল্প ব্যবস্থায় পানি উত্তোলনে একদিকে যেমন খরচ বাড়ছে অন্যদিকে আবার কারো কারো কৃষিজমি করার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে।

 

সুশীল চন্দ্র দাস জানান, বর্তমান সময়ে সুতাং নদীটি আমাদের গলার কাঁটা হয়ে আছে। না পারছি পানি ব্যবহার করতে না পারছি জমি ছেড়ে দিতে। প্রশাসন যদি নদীটি ড্রেজিং করত তা হলে হয়তো কিছুটা হলেও নদীর স্বাভাবিক গতি ফিরত।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বাপার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জুল সোহেল বলেন, ‘অলিপুর এলাকার বেশ কিছু কোম্পানির বর্জ্যে দূষিত হয়ে পড়েছে সুতাং নদী। কৃষিকাজে সেচ ব্যবস্থার নামে শৈলজুড়া নামক খালটি জেলা প্রশাসন ২০১৪ সালে পুনঃখনন করে প্রাণ-আরএফএল ও স্কয়ার কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়। ফলে ওই কোম্পানিগুলোর বর্জ্য সহজেই খালের মাধ্যমে সুতাং নদীতে ছাড়া হচ্ছে। যে কারণে শিল্পবর্জ্য দূষণে সুতাং নদীটি হয়ে পড়েছে মৎস্যশূন্য। নদীর পানি ব্যবহারকারীরা পড়েছেন মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। তাই আমরা চাই এ বিষয়ে যেন প্রশাসন দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

 

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, সুতাং নদীর এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য জেলা প্রশাসন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি কোম্পানিতে অভিযান চালিয়ে জরিমানা আদায় করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের কঠোরভাবে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনের এমন অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।

 

এদিকে, সুতাং নদী পুনরুদ্ধারে নোটিশ প্রদান করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। গ (৯ ফেব্রুয়ারি) মঙ্গলবার ‘নোটিশ অব ডিমান্ড ফর জাস্টিস’ শিরোনামে বেলার আইনজীবী এডভোকেট সাঈদ আহমেদ কবীর রেজিস্ট্রিকৃত ডাকযোগে সচিব ভূমি মন্ত্রণালয়, সচিব পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, সচিব নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, সচিব পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় ও সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে এ নেটিশ প্রদান করেন। এছাড়াও এর অনুলিপি প্রদান করা হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন চেয়ারম্যান, মহাপরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসক হবিগঞ্জ ও পুলিশ সুপার হবিগঞ্জের কাছে।

এ বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপ নোটিশ প্রেরণের ৭ (সাত) দিনের মধ্যে  প্রেরণকারীকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানানো হয় নোটিশে।

 

যাযাদি/ এস