মানুষের মতো বুদ্ধিমান হাতি, কে কার কাছ থেকে শিখেছে

প্রকাশ | ২৯ জুন ২০২১, ১৮:২১

যাযাদি ডেস্ক

 

চীনে এক পাল হাতির অর্ধ-সহস্র কিলোমিটার দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ঘটনায় এই বন্যপ্রাণীটির স্বভাব, বুদ্ধি ও আচার-আচরণের বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়েছে।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিশ্বের কোথাও কোনো হাতির দল এতো লম্বা পথ পাড়ি দিয়েছে বলে আগে কখনো জানা যায়নি।

 

এই হাতির পালটি এক বছরেরও বেশি সময় ধরে, চীনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যে জঙ্গলে তারা বসবাস করতো সেখান থেকে তারা প্রায় পাঁচশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। এই সময়ে দেশটির বেশ কিছু গ্রাম, নগর ও শহরের মধ্যে দিয়ে তারা হেঁটে গেছে।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, কেন ও কীভাবে তারা পর্যটকের মতো ধীরে ধীরে এতো দীর্ঘ পথ পাড়ি দিল তার উত্তর সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব নয়।

 

বাংলাদেশে বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলছেন, ‘মাইগ্রেট করলেও তার একটা সীমানা থাকে, মাইগ্রেট করার পেছনে কারণ থাকে। কিন্তু চীনের যে অঞ্চলে তারা ছিল সেখানে তাদের থাকা ও চাহিদা মেটানোর কোন অসুবিধা ছিল না। তাহলে প্রশ্ন হতে পারে এর পরেও কেন তারা গেল।’

 

বিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করছেন যে এর পেছনে জেনেটিক কারণও থাকতে পারে।

 

‘আমার কেন জানি মনে হয় ওদের পূর্বপুরুষের কেউ হয়তো কখনো দেশ ত্যাগ করে পরিযায়ী হয়েছিল, কিম্বা তাদের মধ্যে ভ্রমণের কিছু ব্যাপার ছিল যার জিন তারা হয়তো বংশ পরম্পরায় পেয়েছে,’ বলেন মি. ইসলাম।

 

তাদের ঘুরে বেড়ানোর জন্য থাকে নির্দিষ্ট একটি এলাকা। কিন্তু এতো দূর ঘুরে বেড়ানো হাতির স্বভাবের মধ্যে পড়ে না। তার পরেও যে এরকম ঘটনা ঘটে না তা নয়।

 

কয়েক বছর আগে ভারতের ঝাড়খন্ড রাজ্য থেকে দুটো হাতি হাঁটতে হাঁটতে পদ্মা নদী পার হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা বাগেরহাটে চলে এসেছিল।

 

ভারতীয় কর্মকর্তারা তখন বাংলাদেশে এসে হাতি দুটোকে অচেতন করে ট্রাকে তুলে তাদের ভারতে ফিরিয়ে নেয়।

 

‘কোন বাধা তাদের আটকাতে পারল না। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে এতোটা পথ পাড়ি দিয়ে তারা এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে এলো- এটাকে আমরা পর্যটন বলবো নাকি অন্যকিছু বলবো, বলা কঠিন,’ বলেন বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ মি. ইসলাম।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের মধ্যে যা আছে সেটা প্রাণীদের মধ্যেও থাকতে পারে। এবং তারা অনেকটা মানুষের মতোই আচরণ করে থাকে।

 

‘মানুষের মতো হাতিও সামাজিক জীব। আমাদের সমাজে ও ব্যক্তি জীবনে যা কিছু ঘটে, হাতির সমাজে এবং জীবনেও তার প্রায় প্রতিটি ঘটনাই ঘটে। হাতিও দলবদ্ধ প্রাণী। এখন বিষয়টা হচ্ছে আমরা হাতির কাছ থেকে শিখেছি না হাতি আমাদের কাছ থেকে শিখেছে!’

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ নিশ্চয়ই হাতির কাছ থেকে শিখেছে। কারণ হাতি আমাদের কয়েক কোটি বছর আগে পৃথিবীতে এসেছে।

 

হাতি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও সংবেদনশীল প্রাণী। অ্যারিস্টটল একবার বলেছিলেন, হাতি হচ্ছে সেই প্রাণী যে বুদ্ধির দীপ্তি ও স্মরণশক্তির দিক থেকে অন্য সকলকে অতিক্রম করেছে।

 

হাতি স্থল প্রাণীদের মধ্যে আকারে সবচেয়ে বড়। তাদের মস্তিষ্কও সবচেয়ে বড়। মানুষের যতো নিউরন আছে তার চেয়েও তিনগুণ বেশি আছে হাতির।।

 

ভারতে দেখা গেছে হাতি আটকাতে ইলকেট্রিক বেড়া দেওয়ার পর তারা প্রথমে তার ওপরে গাছ ফেলে সেখান দিয়ে রাস্তা তৈরি করেছে এবং তার পর ওই পথ দিয়ে চলাচল করেছে। ড্রাম পটকা ফোটালে কিছুদিন পর ওরা বুঝে ফেলে যে ওদের ভয় দেখানোর জন্য এসব ফোটানো হচ্ছে। বিশ্বের অনেক চিড়িয়াখানাতে গেলেও সেখানে এখন হাতিদের ফুটবল খেলতে দেখা যায়। অনেক গ্যালারিতে হাতির ছবি আঁকাও সরাসরি প্রদর্শন করা হয়। তারা নানা ধরনের হাতিয়ারও ব্যবহার করতে পারে। তাদের স্মৃতিশক্তি প্রখর।

 

বিজ্ঞানীরা বলছেন, হাতির এই বুদ্ধি কতখানি - মানুষ হয়তো সেটা পরিমাপ করতে পারেনি। তাদের অধিকার সম্পর্কেও মানুষ সচেতন হয়নি। আর সেকারণেই কখনও কখনও হাতির সঙ্গে মানুষের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে থাকে।

 

বুদ্ধির পাশাপাশি হাতির মানসিক শক্তিও উল্লেখ করার মতো। মানুষের মতো তাদের জীবনেও আছে হাসি কান্না। তারা অনুকরণপ্রিয়, মানুষের মতো তারাও অনুকরণ করতে পারে এবং অন্যদের কাছ থেকেও বহু বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে।

 

সম্প্রতি ভারতে হাতির এরকম একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে যাতে দেখা যাচ্ছে একটি বাচ্চা হাতি চাপকল চেপে চেপে পানি খাচ্ছে।

 

হাতি পরোপকারী একটি প্রাণী। তাদের ভেতরে একে অপরকে সাহায্য সহযোগিতা করার আগ্রহ অত্যন্ত প্রবল। তাদের স্মরণশক্তিও খুব প্রখর।

 

বিশ্বখ্যাত প্রাণীবিজ্ঞানী ইয়েন ডগলাস হ্যামিলটন হাতির ওপর গবেষণার জন্যে সুপরিচিত। হাতি সংরক্ষণে কাজ করার জন্য আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও পেয়েছেন তিনি। তার বিবরণে হাতির স্মরণশক্তির বিষয়ে কিছু ধারণা পাওয়া যায়।

 

দেখা গেছে ডগলাস হ্যামিলটন যেসব বুনো হাতি নিয়ে কাজ করতেন তারা হয়তো কখনও তেড়ে গিয়ে মানুষকে আহত করেছে, কিন্তু হ্যামিলটনের সঙ্গে তাদের ঠিকই বন্ধুত্ব হয়েছে। তাদের সঙ্গে তিনি ছবি তুলছেন। হ্যামিলটন যখন বিয়ে করলেন তখন তার স্ত্রীকে নিয়ে ওই হাতির সঙ্গে ছবি তুলেছেন। পরে যখন তাদের সন্তান হলো তাদের সঙ্গেও ছবি তোলা হয়েছে। স্ত্রী ও সন্তানরা যে ডগলাস হ্যামিলটনের পরিবারেরই সদস্য হাতিরা সেটাও বুঝতে পারছে।

 

হাতির পারিবারিক বন্ধনের উদাহরণ হতে পারে কেনিয়ার একটি ঘটনা। সেদেশের ন্যাশনাল পার্কে শিকারিরা হাতির একটি পরিবারের দুজন সদস্যকে গুলি করলে একটি মারা যায় এবং অন্যটি গুলিবিদ্ধ হয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

 

অন্য হাতিরা তখন তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তারা ওকে সোজা দাঁড় করিয়ে রাখতে সাহায্য করে। কিছুক্ষণ পর হাতিটি মাটিতে পড়ে যায়। তখন ওই হাতির মা ও তার আরো কয়েক সহযোগী মিলে তাকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। এটা করতে গিয়ে মায়ের একটি দাঁতও ভেঙে যায়।

 

অন্য হাতিরা তখন আশেপাশের এলাকা থেকে ঘাস লতাপাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। তারা মনে করে এসব খাওয়ালে হয়তো মৃত হাতিটি জীবন ফিরে পাবে।

 

এখানেই শেষ নয়। হাতিটি মারা যাওয়ার পর তারা সবাই মিলে তাকে সমাহিত করে। সমাহিত করে ওরা সেখানে রাত কাটায় এবং পরদিন সেখান থেকে চলে যায়। মা হাতিটি যায় সবার পরে।

 

অধ্যাপক আনোয়ারুল ইসলাম বলছেন, ‘কোনো হাতি মারা যাওয়ার পর অন্য হাতিরা মানুষের মতোই শোক প্রকাশ করে। তাদের একজন তখন শব্দ করে শোক জানায় এবং বাকিরা নিরবে দাঁড়িয়ে থাকে। আবার আনন্দ উৎসবেও তারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে।’

 

‘আমাদের বাচ্চারা যেমন করে, হাতির বাচ্চারাও কিন্তু পানি নিয়ে খেলা করে। দেখবেন তারা পানি নিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে,’ বলেন তিনি।

 

নানা কারণেই পৃথিবীতে এই হাতির সংখ্যা কমে আসছে।

 

এক হিসেবে দেখা গেছে একশ বছর আগে আফ্রিকাতে হাতির সংখ্যা ছিল ১০ কোটি। এশিয়াতে ছিল এক লাখ। এখন আফ্রিকাতে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে চার লাখের কিছু বেশি আর এশিয়াতে ৪০ হাজার। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

 

যাযাদি/এসআই