নদীটির নাম সুতাং, বর্ষায় যৌবনা, গ্রীষ্মে মরা খাল

প্রকাশ | ২৮ আগস্ট ২০২১, ১৮:১৩

সৈয়দ হাবিবুর রহমান ডিউক, শায়েস্তাগঞ্জ (হবিগঞ্জ)

 

পাহাড়ের কোলঘেঁষা সুতাং নদী এককালের খরস্রোতা। নদীর জোয়ারে পাড় উপচে পানি বেরিয়ে যেত। কালের আবর্তনে নদীর ঐতিহ্য এখন হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে নদীতে জল আর স্রোতে হয় প্রাণের সঞ্চার। নদীটি একসময় বছরের বেশির ভাগ সময়েই থাকত পানিতে ভরপুর। নদীপাড়ের মৎস্যজীবীরা মনের আনন্দে মেতে উঠতেন মাছ শিকারে। চাল্লাইর বিলের কই আর সুতাংয়ের পুঁটিমাছের ঐতিহ্য সারাজেলায় প্রসিদ্ধ ছিল।

 

এখন বর্ষার মৌসুম চলছে, একটানা বৃষ্টিতে নদীর পানি এখন টইটম্বুর হয়ে আছে। চারদিকে পানি থাকায় নদীতে জোয়ার এসেছে। প্রাকৃতিক পানিতে ভরপুর সুতাং নদী যেন খানিকটা হলেও পুরনো যৌবন ফিরে পেয়েছে।

 

সরেজমিনে দেখা যায়, স্থানীয় জেলেরা নদীতে জাল ফেলে মনের আনন্দে মাছ শিকার করছেন। সুতাং নদীর সৌন্দর্য দেখার জন্য অনেক মানুষ এসে নদীর পাড়ে ভিড় করছেন। কেউ কেউ ডিঙি নৌকায় মাছ ধরছেন, আবার অনেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে ভাটি অঞ্চল থেকে দলবেঁধে ডিজে পার্টিসহ ভ্রমণ করতে এসেছেন। সম্প্রতি নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিনই অসংখ্য নৌকা পাড়ে বেঁধে রেখে উৎসবের আমেজে পিকনিক করতে দেখা গেছে ভ্রমণ পিপাসুদের। নদীর পানি এখন স্বচ্ছ থাকায় সকাল কিংবা দুপুরে নদীতে সারিবদ্ধভাবে স্থানীয়দের গোসল করতে দেখা যায়।

 

শুক্রবার সকালে দেখা যায় সুরাবই গ্রামের কুমার হাটির অঞ্জন পাল ভেলা বানিয়ে মনের সুখে নদী পার হচ্ছেন। এমন দৃশ্যের প্রায়ই দেখা মেলে। রাত করে সুতাং নদীর দৃশ্য দেখতে গেলে এখন দেখা মেলে স্থানে স্থানে মাছ শিকারিদের। তাদের অনেককে মশাল জ্বালিয়ে মাছ ধরতেও দেখা যায়।

 

স্থানীয় মাছ শিকারি বাচ্চু মিয়া জানান, রাতের বেলা দেশীয় প্রজাতির বেশ ভালো মাছ ওঠে। এসব মাছের মধ্যে পুঁটি, শিং ও বোয়াল রয়েছে।

 

তিনি জানান, শখের বসেই মাছ ধরতে আসেন, বৃষ্টির সময় মাছ ধরা দেয় বেশি। এসব মাছ ধরে তার পরিবারের মাছের চাহিদা অনেকটাই পূরণ হয়ে যায়।

 

অন্যদিকে, সুতাং নদীতে পানি থাকায় স্থানীয় বাঁশ ব্যবসায়ীরা বাঁশের আঁটি বেঁধে পানিতে ভাসিয়েই উজান থেকে ভাটিতে নিয়ে যান। এতে করে তাদের অতিরিক্ত পরিবহণ খরচও বেঁচে যায়।

 

একসময় সুতাং নদী দিয়ে প্রতিদিনই বড় বড় নৌকা আসা-যাওয়া করত। আর এসব নৌকায় করে ভাটি এলাকার বাদগরি, কাডাখালি, সাধুরবাজারসহ অন্যান্য অঞ্চল থেকে মানুষ নিয়মিত সদাই করে আবার নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতেন। এখন আর নৌপথে এভাবে মানুষজন আসতে দেখা যায় না।

 

বর্ষার মৌসুমেই কেবল ঐতিহ্যবাহী এ নদীতে পানি থাকে। অন্য সময় শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হয়ে যায়। সুতাং নদীর কষ্টের কাহিনী বেশ পুরনো আর লম্বা। একদিকে খননের অভাব, অন্যদিকে নদীর জায়গা দখল। আবার শিল্পায়নের দূষিত পানির কারণেই মূলত নদীর প্রাণ সঞ্চার হয় না। অথচ, এই নদীকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষ নানাভাবে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সুতাং নদীর পানির ওপর এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষকরাই নির্ভরশীল।

 

সুতাং নদীর হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেতে হলে স্থানীয় এলাকাবাসীসহ প্রশাসনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও পরিবেশবাদীরা।

 

এই বিষয়ে বাপা হবিগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। সুতাং নদী একটি সীমান্তবর্তী নদী। বর্ষার মৌসুমে এর আসল রূপ দেখা যায়, যা মানুষকে আকৃষ্ট করে। সুতাং নদীটি নানা সমস্যায় জর্জরিত, যে কারণে বর্ষার মৌসুম গেলেই নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে ওঠে, নদীতে পানি থাকে না। এখনো ভাটি অঞ্চলের মানুষ পারিবারিক অনুষ্ঠানসহ যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে নৌকার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীর তলদেশ শুকিয়ে যাওয়ায় তারাও নৌপথে যাতায়াত করতে পারেন না। সুতাং নদীর হারানো ঐতিহ্য ধরে রাখতে হলে দখল ও দূষণের হাত থেকে এই নদীকে বাঁচাতে হবে। না হলে এই নদীর মৃত কান্নার শেষ কখনোই হবে না। এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সুদৃষ্টি প্রয়োজন।

 

একই বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট শাহ শাহিদা জানান, সুতাং নদী একটি খরস্রোতা নদী। আমরা এ নদী নিয়ে অনেক কাজ করেছি।

 

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিটি নদীই বর্ষার মৌসুমে প্রাণ ফিরে পায়। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে নদীর সৌন্দর্য ধরে রাখা যায় না। সারাবছরই যাতে নদীর পানি থাকে এবং নদীর প্রবাহ যাতে কোথাও বাধাগ্রস্ত না হয় সেজন্য স্থানীয় সামাজিক নেতৃবৃন্দসহ প্রশাসনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

 

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী সুতাং। নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি লাভ করে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তারপর শায়েস্তাগঞ্জ হয়ে লাখাই উপজেলার কালনী নদীতে পড়েছে।

 

যাযাদি/ এস