একিউআই বিশ্ব এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট

নগরবাসীর ৩৬৫ দিনই বায়ু দূষণের মধ্যে বসবাস

মানুষের আয়ু গড়ে তিন বছর কমছে বছরে মারা যাচ্ছেন এক লাখ ২২ হাজার ৪শ' জন; দেশে জিডিপির পাঁচ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে

প্রকাশ | ০৬ অক্টোবর ২০২১, ০০:০০ | আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০২১, ০৯:০২

আলতাব হোসেন

বছরের ৩৬৫ দিনই বিপজ্জনক বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাস করেন ঢাকার মানুষ। বারো মাসই ঢাকার বাতাসে বিষ থাকে। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত পুরো সময়টায় দূষণের মাত্রা থাকে চরম বিপজ্জনক অবস্থায়। আর বাকি পাঁচ মাস থাকে 'খুবই অস্বাস্থ্যকর' অবস্থায়। যার অর্থ শহরের সবাই মারাত্মক বিপজ্জনক স্বাস্থ্য ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। বছরব্যাপী বায়ুদূষণে ঢাকার পরে দ্বিতীয় স্থানে আছে পাকিস্তানের লাহোর আর তৃতীয় অবস্থানে ভারতের মুম্বাই। বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশ এখন বাংলাদেশ। ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জসহ বড় বড় শহরগুলোতে দূষিত বায়ু অব্যাহত থাকে সারা বছর। বায়ু দূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু প্রায় তিন বছর কমছে। দেশে প্রতি বছর এক লাখ ২২ হাজার ৪শ' মানুষের মৃতু্য হচ্ছে। এরমধ্যে শিশু মৃতু্যর হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃতু্যর ক্ষেত্রে চতুর্থ প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ। শিশুদের অ্যাজমা রোগ বেড়ে যাচ্ছে, অসুস্থ বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। আর দেশে জিডিপির পাঁচ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) বিশ্ব এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট ২০২০ প্রকাশ করেছে। এ রিপোর্টে এমন ভয়াবহ তথ্য ওঠে এসেছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে- বায়ুদূষণে ২০২০ সালে বিশ্বে ৭ মিলিয়ন মানুষের অকাল মৃতু্য হয়েছে। আর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন। একিউআই বিশ্বের ১০৬ দেশের বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্য পর্যালোচনায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের প্রথম স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকা। বছরের পুরো সময়টায় রাজধানী ঢাকা বিশ্বের প্রথম বা দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে অবস্থান করে। গত বছরের ১৯ নভেম্বর বৃহস্পতিবার বায়ুদূষণে বিশ্বে শীর্ষে ছিল ঢাকা। দূষণের স্কোর ছিল ১৯৯। মঙ্গলবার সকাল থেকে প্রায় সারাদিনই ঢাকায় বৃষ্টি হয়। তারপরও বায়ুদূষণে বিশ্বে দ্বিতীয় ছিল বাংলাদেশ। প্রথম অবস্থানে ছিল ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা আর তৃতীয় অবস্থানে পেরুর রাজধানী লিমা। ভারতের দিলিস্ন ছিল ৪র্থ অবস্থানে এবং সপ্তম অবস্থানে ছিল পাকিস্তানের করাচি। প্রতিদিনের বাতাসের মান নিয়ে তৈরি করা একিউআই সূচক একটি নির্দিষ্ট শহরের বাতাস কতটুকু নির্মল বা দূষিত সে সম্পর্কে মানুষকে তথ্য দেয় এবং তাদের জন্য কোন ধরনের স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হতে পারে তা জানায়। একিউআই স্কোর ১৫১ থেকে ২০০ হলে নগরবাসীর প্রত্যেকের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়তে পারে, বিশেষ করে শিশু, বৃদ্ধ ও অসুস্থরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। জনবহুল ঢাকা কয়েক বছর ধরেই দূষিত বাতাস নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। মূলত নির্মাণ কাজের নিয়ন্ত্রণহীন ধুলা, যানবাহনের ধোঁয়া, ইটভাটার দূষণ প্রভৃতি কারণে রাজধানীতে দূষণের মাত্রা চরমে পৌঁছেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২০ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার বাতাসে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সালফার ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। ঢাকার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ২৫০ মাইক্রোগ্রাম ধুলোকণা ভেসে বেড়ায়। সহনীয় মাত্রার চেয়ে এই পরিমাণ পাঁচগুণ বেশি। বায়ুদূষণে রাজধানীর ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন। ক্যানসারসহ শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগ বাড়ছে। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে। ফুসফুসের রোগ ও হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বাড়ছে। বায়ুদূষণে মানুষের শরীরে নানা রোগবালাই যেমন বাসা বাঁধছে, তেমনি মনের মধ্যেও রোগ-শোকের জন্ম দিচ্ছে। বায়ুদূষণ মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বাড়াচ্ছে বলে ধারণা করছেন মনোবিজ্ঞানীরা। বুধবার শিকাগো ইউনিভার্সিটির এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত 'এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-২০২০' এই তথ্য প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের বাতাসে এই বস্তুকণা ২.৫ এর পরিমাণ ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম পার কিউবিক মিটার, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদন্ডের চেয়ে সাতগুণ বেশি। দেশের ৬৪টি জেলার প্রত্যেকটিতেই বায়ুদূষণের হার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী তিনগুণ বেশি। শহরে বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী বলা হয়, অতিসূক্ষ্ণ বস্তুকণা ২.৫। যা মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে ঢুকে যায়। শ্বাস-নিঃশ্বাস রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রায় ৬৫ লাখ মানুষ। বেঁচে থাকার জন্য শ্বাস নিতে গিয়ে মানুষ প্রতিদিন ফুসফুসের মাধম্যে দুই হাজার লিটারের বেশি ক্ষতিকর বাতাস গ্রহণ করে থাকেন। এই শ্বাস গ্রহণের সময়েই ফুসফুসে ঢুকছে দূষিত বস্তুকণা। দূষিত বায়ুর এই বস্তুকণা মানুষের মৃতু্যকে ত্বরান্বিত করছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। পরিবেশ অধিদপ্তরে নির্মূল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন রাজধানীর বায়ু বিপজ্জনক পর্যায়ে ছিল। পর্যায়ক্রমে দূষণের মাত্রা বাড়ছে। ২০১৫ সালে দূষণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দিন। এরপর ২০১৬ সালে দূষণ ছিল ১৯২ দিন। আর ২০১৭ সালে ২১২ দিন পর্যন্ত দূষণের কবলে ছিল ঢাকার মানুষ। এরপর ২০১৮ সালের ২৩৬ দিনই ছিল ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা চরম বিপজ্জনক। ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন দূষণের কবলে থাকে ঢাকার মানুষ। সর্বশেষ ২০২০ সালের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বায়ুদূষণে শীর্ষে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় একাধিকবার হাইকোর্ট হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সচিবদের তলব পর্যন্ত করেন হাইকোর্ট। পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করলেও থামেনি দূষণ কার্যক্রম। দূষণের লাগাম টেনে ধরতে দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এর আগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস) শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে ৮০২ কোটি টাকা প্রদান করে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল জানান, দিনের পর দিন বায়ুদূষণ বাড়ছে। ঢাকা ছাড়াও সারাদেশে বায়ু দূষণের পরিমাণ বাড়ছে। ঢাকা তো প্রায় বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে। বায়ুদূষণে স্বাস্থ্য ও আর্থিক খাতের ক্ষতি বিবেচনায় সরকার নির্মূল বায়ু আইন না করে শুধুমাত্র নীতিমালা করার কথা বলছে। সারাদেশের জন্য আইন করা প্রয়োজন। খন্ডিত পদক্ষেপ কখনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, ঢাকাসহ আশপাশের বড় শহরগুলোতে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চলছে। বছর ধরে উন্নয়নমূলক কাজ অব্যাহত থাকায় সারা বছরই দূষণ হচ্ছে। দূষণ রোধে বিভিন্ন প্রকল্প চলমান আছে। দূষণ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা চলছে। এ জন্য সবার মধ্যে সচেতনতা প্রয়োজন। যেখানে-সেখানে নির্মাণ সামগ্রী ফেলে দূষণ করা হচ্ছে।' তিনি বলেন, এসডিজি অর্জনে পুরানো ইটভাটা ভাঙা হচ্ছে। দূষণকারী যানবাহন ও শিল্প কারখানার বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। বায়ুদূষণ বেশি হয়, এমন জেলাগুলোতে বায়ুমান পরিবীক্ষণ যন্ত্র বসানো হয়েছে।