প্রচণ্ড গরমে গলছে হিমবাহ, ভয়াবহ প্রভাব বাংলাদেশে
প্রকাশ | ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:১৮ | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১৪:৩২
দিনের পর দিন উত্তপ্ত হচ্ছে পৃথিবী, গলছে হিমবাহ। বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। আবহাওয়ার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের পর, ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সাল হচ্ছে এই দশকের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম বছর। চলতি বছর ঢাকায় ৫৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৪০ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায় ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি। তীব্র গরমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেঁকে গেছে রেললাইন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী গরমের তীব্রতা আরও বাড়বে। আগামী মে মাসে ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় পুড়বে দেশ। ‘এল নিনো’র প্রভাবে এবার খরতাপের দাপট অতিমাত্রায় বেড়েছে। উষ্ণতম দশক পার করছে দেশ। আবহাওয়ার বৈরী আচরণে মরুভূমির সব সূচক যেন ভর করেছে দেশে! এতে ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষি ও জনজীবন।
এপ্রিল মাসের দিনগুলো রীতিমতো খরা যাচ্ছে। তবে দুই একদিন কালবৈশাখির সঙ্গে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি হয়েছে কোথাও কোথাও। অতিরিক্ত গরমে ফসল ও জনজীবন বিপর্যস্ত। এর মধ্যে রামপাল কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ছয়দিন ধরে বন্ধ। এছাড়া দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ৩৭৫ মেগাওয়াটের তৃতীয় ইউনিটের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বাড়ছে লোডশেডিং। সব মিলিয়ে মে মাসের তীব্র গরম সামাল দেওয়া আরও কঠিন হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে প্রচণ্ড গরমে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের বরফ গলেছে, আর এর ভয়াবহ প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গোপসাগর উপকূলে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এসব অঞ্চলের মানুষ এলাকা ছেড়ে দেশের অন্যান্য স্থানে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নিচ্ছেন। প্রতিদিন ২ শতাংশ ভূমি লবণাক্ত হচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশের উপকূল ছাড়বেন প্রায় ৩ কোটি মানুষ। আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়নে প্রকাশিত নতুন এক গবেষণায় এসব কথা বলা হয়েছে।
প্রকৃতির এই রুদ্রমূর্তি যে শুধু বাংলাদেশের মানুষ একাই দেখছে, তা কিন্তু নয়; বিশ্বজুড়েই আবহাওয়া বিক্ষুব্ধ ও চরম আচরণ করছে। ২০২০ সালে ১০০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করেছে পৃথিবী। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে ১৯১৩ সালের পর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৫৪ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। এটিকেই পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বলছে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস (এনডব্লিউএস)। ২০২০ সালের শুরুতে অস্ট্রেলিয়াজুড়ে প্রায় ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠায় সেখানকার বনভূমিতে দাবানল সৃষ্টি হয়। এরপর ইউক্রেনে ও ব্রাজিলের অ্যামাজানেও একই ধরনের দাবানল হয়। ওই আগুনে দেশ তিনটির বিপুল বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে।
নতুন গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে বঙ্গোপসাগর উপকূল সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
এ কারণে সাগরের লবণাক্ত পানি প্লাবিত করবে কৃষিজমি, মাছের ঘের, বসবাসের জনপদ। ডুবে যাবে বহু এলাকা। ফলে সেখানে মানুষের বসবাসের কোনো উপায় থাকবে না। তাই জীবনধারণের জন্য এসব অঞ্চলের মানুষ শহরমুখী বা দেশের অন্য এলাকায় ছড়িয়ে পড়বেন। এতে আরও বলা হয়েছে, অনেক অভিবাসীকে তার বর্তমান আবাসন থেকে বাস্তুচ্যুত হতে হবে। এ কারণে গণহারে মানুষ এলাকা ছাড়তে থাকবে।
আমেরিকান জিওফিজিক্যাল ইউনিয়ন হলো একটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক গ্রুপ। তারা বলেছে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা হলো এসব অভিবাসীর জন্য জনপ্রিয় স্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে তাৎক্ষণিকভাবে যারা বাস্তুচ্যুত হবেন, তাদের বিষয়টিই অনুধাবন করতে হবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বেড়ে গেলে আমাদের দেশের ১৭ ভাগ ভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ তাদের আবাসন হারাতে পারে, হারাতে পারে তাদের আজন্মের পরিচিত গ্রাম ও অসংখ্য স্মৃতি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে বছরে গড় তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বেড়েছে। শুধু বৈশ্বিক উষ্ণতার ফলে বাংলাদেশে বছরে ৮ হাজার ২৪১ জন মানুষ মারা যাচ্ছে। বিশে^র অন্যান্য দেশের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার বাংলাদেশ। ‘বিশ্ব জলবায়ু ঝুঁকি সূচক-২০২৩’ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলো একসঙ্গে বন্যা ও তাপদাহে পুড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্য তো এ বছর খরা, টর্নেডো আর অতিরিক্ত শীত মৌসুম পেয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় শীত মৌসুমে হালকা তুষারপাত হয়, বসন্তে হালকা বৃষ্টি হয়। এরপর গ্রীষ্ম তো ক্যালিফোর্নিয়ার জন্য আগুনের মৌসুম হিসেবে এসেছে। তাপদাহের কারণে খরা আর ভয়াবহ দাবানলে পুড়ছে ক্যালিফোর্নিয়া। আলজেরিয়া ও নরওয়েতে উচ্চ তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড তৈরি হয়েছে এ বছর। ওমানে রাতের তাপমাত্রা সর্বনিম্ন ৪২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা ওমানের ইতিহাসের সর্বনিম্ন তাপমাত্রার হিসেবে সবচেয়ে বেশি। ইউরোপের দেশগুলো শতাব্দীর মধ্যে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছে।
এবারের গ্রীষ্মে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণ তাপমাত্রা অনুভূত হয়েছে। বছরের বেশির ভাগ সময়ে যেখানে বরফাচ্ছন্ন থাকে, সেখানে এখন বিরাজ করছে তীব্র তাপদাহ। মার্চ মাস থেকে নিয়মিত গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হয়েছে। এর আগে ২০২১ সালের ১৯ জুলাই ছিল বছরের সবচেয়ে উষ্ণতম দিন। ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৭ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ওই দিন দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল রংপুরের রাজাহারহাটে ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৪ সালের ২২ এপ্রিল ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা পাঁচ দশকের সর্বোচ্চ।
এ বছর ভরা বর্ষায় প্রচণ্ড গরম হচ্ছে। অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ গরম পড়ছে। গরমে সাবধান থাকার জন্য কোথাও কোথাও বিশেষ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। স্কুল-কলেজ বন্ধ করা হয়। কোথাও কোথাও উচ্চ তাপমাত্রা আর দাবানলের প্রভাব পড়ছে জীবনযাত্রায়। প্রকৃতি যে বৈরী রূপ নিয়েছে, এ রূপ আগে মানুষ দেখেনি। গ্রিনহাউস গ্যাসের জন্য সারা বছর ঠান্ডা থাকা সাইবেরিয়া অঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়েছে। বরফে ঘেরা পৃথিবীর মেরু অঞ্চল অ্যান্টার্কটিকায় বিশ্ব উষ্ণায়নের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, বরফ গলে যাচ্ছে। গত ২০ বছরে বিশ্বে চরম আবহাওয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। এতে বিশ্বব্যাপী মানুষের পাশাপাশি অর্থনীতিরও প্রচুর ক্ষতি হয়েছে। সামনে অপেক্ষা করে আছে আরও দুর্ভোগ। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা বৃদ্ধিতে কোটি কোটি মানুষের জন্য বিশ্ব বসবাসের অযোগ্য পরিণত হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের মতে, আগামী এক দশকে পৃথিবীর জন্য তাপপ্রবাহ এবং খরা সবচয়ে বড় হুমকি হয়ে আছে।
চলতি শতকের ২০ বছরে বিশ্বের যে ১০টি দেশ সবচেয়ে বেশি দুর্যোগ-আক্রান্ত হয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ নবম। এ সময়ে বাংলাদেশের ১১ কোটি ২০ লাখ মানুষ দুর্যোগের শিকার হয়েছেন। আগের ২০ বছরের তুলনায় গত ২০ বছরে বিশ্বে সব ধরনের দুর্যোগ, প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি বেড়েছে। এই সময়ে যে ১০টি দেশ সবচেয়ে দুর্যোগের শিকার হয়েছে, তার আটটিই এশিয়ার। এশিয়ার বাইরের দু’টি দেশ হলো যুক্তরাষ্ট্র (দ্বিতীয় অবস্থান) ও মেক্সিকো (অষ্টম)। এশিয়ার আটটি দেশ হলো চীন (প্রথম), ভারত (তৃতীয়), ফিলিপাইন (চতুর্থ), ইন্দোনেশিয়া (পঞ্চম), জাপান (ষষ্ঠ), ভিয়েতনাম (সপ্তম), বাংলাদেশ (নবম) ও আফগানিস্তান (দশম)।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আবহাওয়াকে উত্তপ্ত করে তোলা নানা গ্যাসের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে আগামীতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা আরও বেড়ে যাবে। যার প্রভাবে নতুন নতুন অঞ্চলে দাবদাহ এবং খরা দেখা দেবে। জলবায়ু সংকটকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বনেতারা দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে এই সংকট মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়বে। জাতিসংঘের দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসসংক্রান্ত অফিস ‘ইউএনডিআরআর’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমনে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা নিতে বিশ্ব রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক নেতাদের ব্যর্থতায় এই গ্রহ ধীরে ধীরে কোটি কোটি মানুষের জন্য বসবাস অযোগ্য নরকে পরিণত হচ্ছে।
যাযাদি/ এস