জলবায়ুর প্রভাব 

প্রকট হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ

দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে, জীবনযাত্রার মানে অবনতি ঘটছে, বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও পাকিস্তানে বন্যার ঝুঁকি বাড়ছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী বসবাসের অনুপযোগী হবে

প্রকাশ | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১০:০৯

আলতাব হোসেন

জীবন ও অর্থনীতির অস্তিত্বের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন একটি হুমকি। চরম তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা ও খরা, অধিকতর তীব্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন, নদীভাঙন, সাগরে লবণাক্ততা বৃদ্ধি বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক ঘটনায় বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জলবায়ুর প্রভাবে দেশে ক্রমেই প্রকট হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াবহ বিপদ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের উপক‚লীয় এলাকায় লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। বাংলাদেশে এরই মধ্যে জলবায়ু অভিবাসীদের সংখ্যা ৭০ লাখ ছাড়িয়েছে। ২০৫০ সালে দেশের প্রতি ৭ জনে একজন জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হবেন। নারীদের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব বেশি। বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে সেই ধারা অব্যাহত থাকলে রাজধানী ঢাকাসহ পাঁচটি বড় শহর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়বে। গত ২০ বছরে রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী এই চারটি জেলা শহরে রাত ও দিনের তাপমাত্রার পার্থক্য বা তারতম্য কমে আসবে, ফলে সব সময় গরম অনুভ‚ত হবে।

এ বিষয়ে নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ডক্টর এস. এম. মনজুরুল হান্নান খান বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং পরিবেশের বৈরী আচরণ অব্যাহত থাকলে জলবায়ুর ক্ষতি ভয়াবহ হবে বাংলাদেশে। দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ক্লাইমেট চেঞ্জ রেজিলেন্স ইনডেক্সের তথ্য অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনে খরা, বন্যা ও শস্যহানির কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে সাত হাজার ৯০০ কোটি মার্কিন ডলারের ক্ষতি হবে। একই সময় জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় থাকা বাংলাদেশের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। সূচকে বিশ্বের ৮২টি বৃহৎ অর্থনীতির দেশের প্রস্তুতি পরিমাপ করে দেখানো হয়েছে। তাতে তাপমাত্রার বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জিডিপি ৩ শতাংশ কমতে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ১০০ কোটির বেশি মানুষ উদ্বাস্তু হতে পারে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে এ বিশালসংখ্যক মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবে। 

দ্য ল্যানসেট মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১০ সাল থেকে বিশ্বে আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগ ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ২০২১ সাল থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত বিশ্বে ৭৯৭টি চরম দুর্যোগপূর্ণ ঘটনা ঘটে। আড়াই বছরে বিশ্বস্বাস্থ্য খাতে ১২৯ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। 

দক্ষিণ এশিয়ার জীবনমানে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিবর্তনের প্রভাব শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তিন-চতুর্থাংশ মানুষের জীবনযাত্রার মানে অবনতি ঘটবে। জলবায়ুর এই ঝুঁঁকিতে নেতিবাচক প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ১৩ কোটি ৪০ লাখ মানুষ। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট জিডিপির ৬ দশমিক ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। 

এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এবং জার্মান সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ‘সর্বনাশা’ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। আন্তঃরাষ্ট্রীয় ক্লাইমেট চেঞ্জের (আইপিসিসি) বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের নিম্নাঞ্চলীয় এলাকার ৯৩ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। এতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে বন্যার ঝুঁকি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ার আশঙ্কা করা হয়েছে। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, ঝড়-পরবর্তী বন্যার ঝুঁকিতে থাকা মানুষের সংখ্যা এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে চীন, ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়া মাঝেমধ্যেই ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। 

এ বিষয়ে জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ডক্টর আমিনুল ইসলাম বলেন, উপক‚লীয় ঝড়ের কারণে নদীতীরবর্তী মানুষের একটা বড় অংশের উদ্বাস্তু হবে। এ শতকের শেষে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন সত্তে¡ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৪০ সেন্টিমিটার বাড়তে পারে। এর সঙ্গে রয়েছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খরা। প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, যে কোনো সময়ের চেয়ে খরা এবং ফসলের ক্ষতি বাড়বে। গবেষকদের দাবি, জলবায়ুর পরিবর্তন অব্যাহত থাকলে এসব দেশের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি মারাত্মক ক্ষতি হবে। দেশের উন্নয়নমূলক অর্জন পানিতে যাবে। জীবনযাপনের মান হ্রাস পাবে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এক আর্থিক প্রতিবেদনে বলেছে, বৈশি^ক তাপমাত্রা যত বাড়বে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকট তত বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনে বিভিন্ন দেশে মারাত্মক খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, দাবানলে বিনিয়োগের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। আইএমএফের ধারণা, জলবায়ু দুর্যোগের কারণে ২০৫০ সাল থেকে প্রতিবছর বিনিয়োগকারীরা বিপুল পরিমাণ সম্পদ হারাতে পারেন। তারা ৬৮টি উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জলবায়ু প্রভাবের বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, প্রাক-শিল্পায়ন সময় থেকে এখন পর্যন্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। বর্তমানে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের মাত্রা যা চলতি শতাব্দী শেষনাগাদ তাপমাত্রা ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। আর এই তাপমাত্রা বৃৃৃদ্ধির ফলে অনিবার্য কিছু প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখোমুখি হতে হবে বিশ্বকে। এসব দুর্যোগের মধ্যে রয়েছে খরা, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা ও নদীভাঙন। এ ছাড়া সমুদ্রসীমার উচ্চতা বেড়ে যেতে পারে। এমনকি বিশ্বের কিছু অঞ্চলের এমন অবস্থা হবে যে যেখানে মানুষ বসবাস করতে পারবে না।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৮০ সালের পর বিশে^ চরম প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘটনা বেড়েছে। গত ২০ বছরে গড়ে প্রতিবছর ৯০০টির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটেছে। ১৯৮০ দশকে বছরে যেখানে বৈশি^ক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ২০০ কোটি ডলার, এখন তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার কোটি ডলারে। গত ৩০ বছরে প্রতিবছর গড়ে বৈশ্বিক জিডিপির ২ শতাংশ হারাতে হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে। আগামী দশকে তা ৯ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। 

বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (ডব্লিউএমও) জানায়, বিশ্বের দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর ২০১৬, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২২ সাল। তাপদাহ, খরা, দাবানল ও প্রবল ঘূর্ণিঝড় আবহাওয়া সংক্রান্ত এ বিষয়ের তথ্য বিবেচনায় নিয়ে একটি বছরকে চিহ্নিত করা হয়, সেই বিবেচনায় ২০২৩ সালকে ১৮৫০ সালে রেকর্ড শুরুর পর থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় উষ্ণতম বছর হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। ২০২৩ সালে প্রচণ্ড গরমে ইউরোপ থেকে আমেরিকা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, সাইবেরিয়ায় ব্যাপক দাবানল হয়। বিশাল অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এসব আগুনের ধোঁয়া বিশ্বজুড়ে মেঘের মতো স্তর তৈরি করে।

বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওড় এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে দেশের ১৭ ভাগ ভূমি পানিতে তলিয়ে যাবে। এতে প্রায় তিন কোটি মানুষ তাদের আবাসন হারাতে পারে, হারাতে পারে তাদের পরিচিত গ্রাম ও অসংখ্য সুখস্মৃতি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে জলবায়ুর প্রভাবে ২০২৪ সাল আমাদের আরেকটি অস্বাভাবিক গরমের বছরের লাল সংকেত দেখাচ্ছে। 

যাযাদি/ এসএম