কণ্ঠযোদ্ধার সঙ্গে কিছুক্ষণ...

প্রকাশ | ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ০০:০০ | আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮, ১১:৫৭

তারার মেলা রিপোটর্
শাহীন সামাদ

শাহীন সামাদ। বিপ্লবী এক কণ্ঠযোদ্ধার নাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কণ্ঠকে হাতিয়ার বানিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছিলেন গানে গানে। ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার হয়ে শরণাথীর্ শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে প্রতিবাদী গান গেয়ে সবার মাঝে দেশাত্মবোধ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূণর্ ভূমিকা পালন করেছেন। আসন্ন বিজয় দিবস উপলক্ষে তারার মেলার মুখোমুখি হন একুশে পদকপ্রাপ্ত এই শিল্পী। তুলে ধরেন যুদ্ধেরদিনের নানা স্মৃতি। উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের পূবর্বতী সময় থেকে বতর্মান সময়ের সম-সাময়িক বিষয়গুলোওÑ আসন্ন বিজয় দিবসের প্রসঙ্গ তুলতেই নিমিষেই যেন তিনি চলেন গেলেন ৪৭ বছর আগের সেই দিনগুলোতে। সব যেন চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন তিনি। অনেকটা নিবার্ক হয়ে অবাক চোখে একনাগারে বলে চললেন, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার হয়ে বিভিন্নস্থানে অনুষ্ঠান করছিলাম। ঠিক সেই সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমাদের ডাক আসে। আমরা সেখানে গিয়ে শুরুতে ৬টি গান গেয়ে আসি। এরপরে টালিগঞ্জ টেকনিশিয়ান স্টুডিও থেকে আরও ১৪টি গান রেকডর্ করে স্বাধীন বাংলা বেতারে পাঠাই। এটি জুন-জুলাইয়ের কথা। সেই সময় আমাদের কণ্ঠে ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’, ‘শিকল পরার ছল’, ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায়’, ‘খঁাটি সোনার চেয়ে খঁাটি’, ‘বাংলা মা দুনির্বার’, ‘মানুষ হ মানুষ হ’, ‘ফুল খেলিবার দিন নয়’, ‘দেশে দেশে গান গাহি’, ‘বল বলরে সবে পাক পশুদের মারতে হবে’, ‘শুনেন শুনেন ভাই সবে’, ‘ব্যারিকেড বেয়োনেট’, ‘প্রদীপ নিভিয়ে দাও’ শীষর্ক গানগুলো শোনা গেছে।” কথা যেন তাকে পেয়ে বসে। খানিক দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন তিনি। যুদ্ধের ভয়াবহতার বিবরণ দিয়ে শাহিন সামাদ বলেন, তখন আমার বয়স ১৮ বছর। কলেজে পড়ি। থাকতাম লালবাগে। আমাদের বাড়ির উল্টো পাশেই পাকবাহিনীর ক্যাম্প ছিল। আমরা তিন ভাই তিন বোন। অনেক ভয়ের মধ্যে আমাদের সময় কাটতো। কারণ তারা তরুণ ছেলেমেয়েদের দেখলেই হিংস্র বাঘের মতো ঝঁাপিয়ে পড়ত। ভয়ে ঘর থেকে কেউ বের হতাম না। পাক-বাহিনীরা রাস্তায় ট্যাংক দিয়ে মহড়া দিত। ভয়ে পুরো এলাকা থমথম হয়ে গিয়েছিল। অনেকটাই গৃহবন্দি হয়ে পড়েছিলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে ছায়ানটে যেতে হতো। তাও খুব বেশি যাওয়ার সুযোগ পেতাম না। ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল কলকাতার উদ্দেশে রওনা হই। অনেকটাই লুকিয়ে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে। আমি শৈশব থেকেই গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। সে কারণে গানের মাধ্যমেই যুদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। দীঘর্ সময় পশ্চিমবঙ্গে ছিলাম। তবে স্বাধীনতার মাস দুয়েক পর দেশে ফিরে আসি। কলকাতায় থাকাকালীন পরিবারের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। তবে শুনেছি, পাকসেনারা আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমাদের পরিবারের সবাই পালিয়ে ছিলেন। আমি জানতাম না, আমার পরিবারের লোকজন কেমন আছে, কোথায় আছে? আর তারাও জানত না, আমি বেঁচে আছি, না মরে গেছি। আমরা ১৭ জন শিল্পী একত্রে দেশ ছেড়ে কলকাতায় গিয়েছিলাম। ওপার বাংলায় আমাদের পাশে এসে দঁাড়ান লেখক-সাংবাদিক দীপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। আমরা তার বাসায় উঠি। তিনি তখন ১৪৪নং লেনিন সরণির একটি দোতলা বাড়িতে থাকতেন। বাড়িটার নিচের তলায় আমাদের থাকার জায়গা হলো। এ সময় আমার সঙ্গে আরও ছিলেন সনজিদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, সৈয়দ হাসান ইমাম, মুস্তাফা মনোয়ার, আলী যাকের, তারেক আলি, আসাদুজ্জামান নূর, ইনামুল হক, বিপুল ভট্টাচাযর্, মোশার্দ আলি, ডালিয়া নওয়াজ ও দেবু চৌধুরী। আমরা সবাই মরহুম শেখ লুৎফর রহমান, আলতাফ মাহমুদ এবং পটুয়া কামরুল হাসানের কাছে গান শিখতাম। এক সময় সবাই মিলেই গঠন করলাম ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’। শুরুতে এই শিল্পী সংস্থায় আমরা ১৭ জনই ছিলাম। এরপর একে একে যোগ দেন আরও অনেক শিল্পী। শেষ পযর্ন্ত আমাদের সংখ্যাটা দঁাড়ায় ১১৭ জনে। ১৬ ডিসেম্বর সকাল থেকেই নানা মানুষের মুখে শুনতে থাকি, দেশ স্বাধীন হয়েছে। তবে দুপুরের দিকে স্বাধীন হওয়ার সংবাদটি নিশ্চিত হই।’ প্রশ্ন ছোড়া হলো, একজন নারী হয়ে এতটা শক্ত-মানসিকতা কোথা থেকে পেয়েছিলেন? খানিক হেসে শাহিন সামাদের জবাব, আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম আগত দিনগুলোর কথা ভেবে। তারপরেও মনোবল হারাইনি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দেশের জন্য কিছু একটা করব। অস্ত্র দিয়ে না পারি, কণ্ঠ তো আছে। এই কণ্ঠ দিয়েই যুদ্ধ করব। সেটাই করেছি মহান মুক্তিযুদ্ধে। প্রেরণাদায়ী গান গেয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনীর ভাইদের সাহস যুগিয়েছি। এটা রণক্ষেত্রের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’ বতর্মান প্রজন্ম নিয়ে শাহীন সামাদ বলেন, নতুন প্রজন্মদের মধ্যে স্বাধীনতার চিন্তাচেতনা পুরোপুরিই কাজ করে। ওরা এখন সবকিছুই বুঝতে পারে, অনেকটাই প্রগ্রেসিভ। ওরা যা করছে, ভালো বুঝেই করছে। আমরা যদি ৪৬ বছর আগে এত কম লোকজন নিয়ে দেশ স্বাধীন করে আনতে পারি, এখন তো প্রায় ১৮-১৯ কোটির মতো মানুষ। তাহলে নতুন প্রজন্ম কেন পারবে না? বুঝবে না? তা ছাড়া ইন্টারনেটের যুগে তারা এখন সবকিছুই দেখছে, সচেতন হচ্ছে। আমি তো সম্পূণর্রূপে আশাবাদী। সবশেষে শাহীন সামাদ বলেন, আমাদের দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। আমাদের নিজস্ব পাসপোটর্ আছে, আগে আমরা কয়টাইবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করার সুযোগ পেতাম। আর এখন বিদেশে সরকারি ও ব্যক্তি পযাের্য় অনেক অনুষ্ঠান হচ্ছে। ’৭১-এর পরবতীর্ সেই বাংলাদেশ আর বতর্মান বাংলাদেশ অনেক পাথর্ক্য। আমরা এখন নিজরাই স্বয়ংসম্পূণর্ ।