শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

দেশি ফল শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

সুরাইয়া বিনতে রহমান
  ২২ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

এখন আর মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না, এখন সারা বছরই মিলছে জিভে জল আনা নানা জাতের টাটকা দেশি ফল। বাহারি রং ও স্বাদের নানা দেশি ফলের ম-ম গন্ধ আর ভ্রমরের গুঞ্জনে মুখর থাকে ফলের বাজার। আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, আমড়া, মাল্টা, ডালিম, চালতা, আপেলকুল, করমচা, জামরুল, কতবেল, কামরাঙা, আমলকী, লটকন, আনারস, জাম্বুরাসহ নানান ফল সারা বছরই দিয়ে যাচ্ছে পুষ্টির জোগান। সারা বছরই এখন দেশি ফলের ভরা মৌসুম। দেশীয় রসালো ফলে প্রকৃতি ঢেলে দিচ্ছে রসের ডালি। চিকিৎসকরাও বলছেন, বেশি বেশি দেশি ফল খাওয়ার। দেশি ফলে বেশি পুষ্টিগুণ রয়েছে।

বাংলাদেশ দানাদার জাতীয় খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও ফলের চাহিদা এখনো সম্পূর্ণ পূরণ করা হয়নি। ফল আমাদের শরীরে ভিটামিন ও খনিজ লবণ সরবরাহ করে। ফল কম গ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশে ভিটামিন ও খনিজ লবণের অভাবজনিত অপুষ্টি যেমন রাতকানা, অন্ধত্ব, রক্তস্বল্পতা, স্কার্ভি, বেরিরেরির হার পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের চেয়ে বেশি। ফলকে রোগ প্রতিরোধক খাদ্য বলা হয়। ফল আমাদের শরীরে রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তোলে। অথচ আমরা ফলকে খাদ্য হিসেবে গুরুত্বই দেই না। পুষ্টিবিদরা একজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের দৈনিক ১০০ গ্রাম ফল গ্রহণ করার সুপারিশ করেছেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা আমাদের শরীরের চাহিদার তুলনায় অনেক কম পরিমাণ ফল গ্রহণ করছি।

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য দৈনিক মাথাপিছু কমপক্ষে ১০০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। সে ক্ষেত্রে দেশে দৈনিক গড় প্রাপ্যতা মাত্র ৪০ গ্রাম। এর মধ্যে কাঁঠাল ফলের পুষ্টি চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করে। বহুমুখী গুণের অধিকারী কাঁঠালে বিদ্যমান ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস জটিল রোগ আলসার, ক্যান্সার, উচ্চরক্তচাপ ও বার্ধক্য প্রতিরোধে সক্ষম। সর্দি-কাশির সংক্রমণ ও বদহজম ঠেকাতে কাঁঠাল বেশ কার্যকর। এর ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালসিয়াম হাড় ও মাড়ি শক্তিশালী করে। পেয়ারাও এখন অনেক সুলভ। সবার কাছেই এটি বেশ পছন্দের। বর্তমানে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতিরপেয়ারার চাষ হচ্ছে। বেশির ভাগ দেশি ফলেরই পুষ্টিগুণ অনেক বিদেশি ফলের চেয়ে বেশি। তাই পুষ্টিবিদরা নিয়মিত কোনো না কোনো দেশি ফল খাওয়ার পরামর্শ দেন।

কয়েক বছর আগে সেপ্টেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত এই পাঁচ মাস বাজারে দেশি ফলের সরবরাহ কম থাকত। কৃষিবিজ্ঞানীরা নিরলস গবেষণায় উদ্ভাবন করেছেন এই সময়ের আবহাওয়া উপযোগী একাধিক জাতের মৌসুমি ফল। এখন এই সময়টায় পাওয়া যাচ্ছে বাউকুল, আপেলকুল, সফেদা, দেশীয় উপযোগী থাই পেয়ারা, সাদা ও লাল জামরুল, ডালিম, আমলকী, কমলা, মাল্টা, আতা ও আগাম জাতের তরমুজ।

সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, এখন কয়েকটি বিদেশি ফল দেশেই চাষ হচ্ছে। বিদেশি হলেও এগুলোকে দেশে চাষের উপযোগী করেছেন কৃষি গবেষকরা। এর মধ্যে অ্যাভোকাডো, স্ট্রবেরি, ড্রাগন, প্যাশন, পার্সিমন, নাশপাতি, রামবুটান অন্যতম। বাংলাদেশের মৌসুমি ফল রপ্তানি হচ্ছে যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন এবং ওমানে। রপ্তানিকৃত ফলের মধ্যে আছে কাঁঠাল, বাতাবি লেবু, কুল, সাতকরা, আম, আমড়া, জলপাই ও পেয়ারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশন, পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক নাজমা শাহীন যায়যায়দিনকে বলেন, নিয়মিত ফল খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। দেশি ফলে প্রচুর ভিটামিন 'এ' এবং 'সি' রয়েছে। ফল লো ক্যালরিযুক্ত খাবার। ফলে থাকে ফাইবার, যা খাবার হজমে সাহায্য করে। দেশীয় ফলে ভেষজ গুণ অনেক। এতে প্রচুর অ্যান্টি-অ্যাসিডিক থাকে। ভিটামিন, মিনারেল ও এনজাইমসমৃদ্ধ ফল রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে। অনেক ফল আছে যেগুলো ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে। তাই দেশি ফল বেশি বেশি খেতে হবে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য মঞ্জুর মুর্শেদ আহমেদ বলেন, এখন বাজারে পেয়ারা ও আমলকী পাওয়া যাচ্ছে। এগুলোতে পুষ্টি উপাদান প্রচুর। দেশের মানুষের একটি ভুল ধারণা হচ্ছে, বিদেশি ফল আপেল ও আঙুরে বেশি ভিটামিন। রোগী দেখতে গেলে তারা সচরাচর এসব ফল নিয়ে যান। এটা ভুল ধারণা। বিদেশি ফল দেশে আসতে অনেক সময় লাগে। অনেক ক্ষেত্রে এসব ফলের পুষ্টি উপাদান কমে যায় বা নষ্ট হয়। বরং দেশি টাটকা ফলেই পুষ্টি উপাদান অটুট থাকে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুহাম্মদ আসাদুলস্নাহ জানান, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ১৩০ ধরনের এক কোটি ১০ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে উৎপাদন ছিল এক কোটি ছয় লাখ টন। দেশে উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৭০ ধরনের ফল।

তিনি আরো বলেন, আম উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম স্থান বাংলাদেশের। পেয়ারায় অষ্টম স্থান। বিশ্বে কাঁঠাল উৎপাদনে শীর্ষে বাংলাদেশের নাম। গত বছর ১৬ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়েছে। এখন বিদেশি ফলও দেশেই চাষ হচ্ছে। ফলে মানুষ টাটকা ফল খেতে পারছে। হারিয়ে যাওয়া অনেক জনপ্রিয় ফলকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা এখন সারাদেশের যে কোনো স্থানে আমড়া, পেয়ারা, ডালিম ও কুল ফলানোর উপযোগী জাত উদ্ভাবন করেছেন। সারাদেশেই এখন এসব ফল উৎপাদন করা হচ্ছে। বছরব্যাপী দেশি ফলের উৎপাদন বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বারোমাসি জাতের আম, মাল্টা, কুল, জামরুল, ডালিম ও কাঁঠালের উৎপাদন বাড়ানো হয়েছে। পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের কার্যক্রম চলছে।

বাংলাদেশ হার্র্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের চিকিৎসক রাজিয়া সুলতানা বলেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু ফল আবাদের জন্য খুবই উপযোগী। বর্তমানে দেশে প্রায় ১৩০ রকম ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৭০ রকম প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের আবাদ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হচ্ছে। ফল একটি অর্থকরী ফসল। ফল গাছ কাঠ দেয়, ছায়া দেয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। ফল ভেষজ বা ঔষধিগুণে সমৃদ্ধ। নিয়মিত ফল খেলে রোগ প্রতরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ সবল জীবন লাভ করা যায়। এ সত্ত্বেও আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক পুষ্টিহীনতার শিকার। বাংলাদেশের প্রায় ৮৮ ভাগ মানুষ ভিটামিন 'এ', ৯০ ভাগ মানুষ ভিটামিন 'সি', ৯৩ ভাগ মানুষ ক্যালসিয়ামের অভাবে ভোগে। আমাদের এ পুষ্টি ঘাটতি পূরণে ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে দেশি ফল আসে ঢাকার আড়তগুলোতে। খুচরা বিক্রেতাদের হাত হয়ে সেগুলো পৌঁছে যায় ভোক্তাদের নাগালে। রাজধানীতে ফলের প্রধান পাইকারি বাজার হচ্ছে- পুরান ঢাকার বাদামতলী, পুরানা পল্টন, শান্তিনগর ও কারওয়ানবাজার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৌসুমি ফল প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্যোগ নিলে তা দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করবে। ফল উৎপাদনকারীরাও উপকৃত হবেন।

কারওয়ানবাজার পাইকারি ফল বিক্রেতা জহিরুল বলেন, এখন সারা বছরই দেশি ফলের জোগান থাকে। চাহিদাও থাকে তুঙ্গে। মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর থেকে পেয়ারা কিনে ফিরছিলেন স্কুল শিক্ষক আতাউর রহমান। তিনি বলেন, পেয়ারা, জাম্বুরা আর কলা কিনলাম। দুই সন্তানকে তিনি নিয়মিত দেশি ফল খেতে দেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে