বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জাতিসংঘের সেরা প্রকল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে দেশের ভাসমান ধাপে বিষমুক্ত সবজি চাষ

এস এম নজরুল ইসলাম, গোপালগঞ্জ
  ২২ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জলাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বছরের পাঁচ থেকে আট মাস হাত গুটিয়ে বসে না থেকে কৃষকরা নিজেরাই ফসল উৎপাদনের উপায় বের করেছেন। কৃষকরা কচুরিপানা, লতাপাতা, দুলালীলতা, শ্যাওলা, টেপাপানা ও গুঁড়িপানা ইত্যাদি জলজ উদ্ভিদের সঙ্গে খড়কুটা ও নারিকেলের ছোবড়ারগুঁড়া স্তরে স্তরে সাজিয়ে, পানির ওপর ভাসমান ধাপ তৈরি করে তাতে সারা বছর ফসল উৎপাদন করছেন। এই উদ্ভাবন বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলার দামাল কৃষকরা। জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতিসংঘের সেরা অভিযোজন প্রকল্পের স্বীকৃতি পেয়েছে 'ভাসমান ধাপে ফসল চাষ' পদ্ধতি। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এএফও) কৃষি ঐতিহ্য অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কৃষকদের ব্যক্তিগত এ উদ্ভাবন জলবায়ু মোকাবিলায় একটি নতুন কৌশল হিসেবে বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে।

কৃষি বিভাগের তথ্য মতে গোপালগঞ্জের পাঁচ উপজেলায় ধাপে সবজি চাষ করছে প্রায় তিন হাজার পরিবার। তারা বিলের কচুরিপানা দিয়ে প্রায় ২০ হাজারটি ধাপ তৈরি করে সেখানে চাষ করছে, মিষ্টি কুমড়া, ঝিঙে, লালশাক, পুঁইশাক, করলা, বরবটি, শসা, ঢ্যাঁড়শসহ বিভিন্ন প্রকার সবজি। এসব সবজিতে কোনো প্রকার রাসয়নিক সার বা কিটনাশক দেয়া হয় না বলে দাবি কৃষি বিভাগ ও জেলার চাষিদের।

এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, গোপালগঞ্জের পাঁচ উপজেলার মধ্যে টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়া উপজেলায় ধাপের উপর বেশি চাষ হয়ে থাকে। এসব এলাকা একদিকে যেমন নিম্ন জলাভূমি বেষ্টিত এবং মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা। এই কারণে কচুরিপানা দিয়ে তৈরি ধাপ পদ্ধতির মাধ্যমে এখানকার কৃষকরা বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি উৎপাদন করে থাকে। তাতে ফলনও ভালো হয় আবার প্রতিকুল পরিবেশ মোকাবিলা করে অধিক ফলন হয়। এতে এলাকার সবজির চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি নিজেদের আর্থিক অবস্থারও উন্নতি করতে পারছেন চাষিরা। বিশেষ করে অতি সম্প্রতি বন্যা ও অতিবৃষ্টিতে সবজি ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হলেও ধাপের উপর চাষ করা সবজি কিন্তু নষ্ট হয়নি। এসব চাষি এখন ভালোদামে তাদের সবজি বিক্রি করছে।

টুঙ্গিপাড়া উপজেলার বন্যাবাড়ী গ্রামের বরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস বলেন, বর্ষা মৌসুমে আমাদের এলাকায় কৃষকের কোনো কাজ থাকে না। তাই এখানকার কৃষকরা বিলে জমে থাকা কচুরিপানা দিয়ে ধাপ তৈরি করে লাল শাক, পুঁইশাক, ঢঁ্যাড়শ, মিষ্টিকুমড়া, শসাসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে থাকে।

শুধু বরেন্দ্রনাথ বিশ্বাসই নয়, টুঙ্গিপাড়া উপজেলার মিত্রডাঙ্গা গ্রামের বন্যাবাড়ী গ্রামের ভূপতি বিশ্বাস, সুব্রত মন্ডল, মো. মান্নান শেখ, হিরামন বিশ্বাস, সুশান্ত বিশ্বাসসহ বেশ কয়েকজন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, আমাদের এলাকায় একবার ফসল হয়। বাকি সময়টা থাকে পানিতে নিমজ্জিত। তাই কচুরিপানা দিয়ে ভাসমান চাষ করি। শুকনার সময় এসব ধাপ উঁচু জমিতে নিয়ে বিছিয়ে দিই এবং শীতকালীন সবজি ফুলকপি, বাঁধাকপি, ওলকপি, মরিচ, লাউ, পালংশাক, লালশাকসহ বিভিন্ন ধরনের চাষ করি। এর উপরই আমরা দরিদ্র মানুষ জীবিকা নির্বাহ করি।

এ ব্যাপারে গোপালগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. অরবিন্দ কুমার রায় বলেন, গোপালগঞ্জে এ বছর অন্তত ২০ হাজারটি ধাপের উপর চলছে ভাসমান সবজি চাষ। আর এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন দুই সহস্রাধিক কৃষক। এ সময়ে নিম্ন জলাভূমি এলাকার মানুষের হাতে কোনো কাজ থাকে না। ধাপের উপর সবজি চাষ করে তারা ভালোই আছেন। তিনি জানান, বন্যা আসুক আর বৃষ্টি-বর্ষা আসুক না কেন, এই পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা সবজিতে তার কোনো প্রভাব পড়ে না। তাছাড়া কীটনাশক ও সারবিহীন উৎপাদিত এই সবজি এলাকার মানুষের কাছে বেশ জনপ্রিয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে