বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

পানিফলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনা ব্যাপক

কৃষিবিদ মোহম্মদ রেজওয়ান মোলস্না
  ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

পানিফল একটি জলজ কন্দলজাতীয় ফসল। এর বৈজ্ঞানিক নাম ঞৎধঢ়ধহধঃধহং। এ ফসল চাষের জমি হিসেবে ডোবা, খাল-বিল, ও মৎস্য ঘের সুবিধাজনক। সামান্য লবণাক্ত ও মিষ্টি পানিতে চাষ করা যায়। তাছাড়া পানিফল গাছ কচুরিপানার মতো পানির উপরে ভেসে থাকে, পাতার গোড়া থেকে শিকড়ের মতো ডগা বের হয়ে বংশ বিস্তার করে এবং ফল ধারণ করে।

পানিফল চাষে খুব বেশি পরিশ্রম প্রয়োজন হয় না। সার ও কীটনাশকের পরিমাণ কম লাগে। ফল কচি অবস্থায় লাল পরে সবুজ এবং পরিপক্ক হলে কালো রং ধারণ করে। ভেতরের সাদাশাস ভক্ষণীয় অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কাঁচা এবং সিদ্ধ দুভাবেই খাওয়া যায়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশ আফ্রিকার, অস্ট্রেলিয়া এবং প্রশান্তমহাসাগরীয় দীপপুঞ্জের দেশসমূহে এদের জন্মাতে দেখা যায়। প্রায় ৩০০০ বছর আগে থেকেও চীনে পানিফলের চাষাবাদ হচ্ছে। শুধু চীন নয়, বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, জাপানসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ করা হচ্ছে। এটি একটি মৌসুমি ফল এবং বর্ষাকালের শেষ থেকে শীতকালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পাওয়া যায়। তবে প্রক্রিয়াজাতকৃত পানি ফলের সহজলভ্যতা সারাবছরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পরিলক্ষিত হয়। কচকচে হালকা মিষ্টি স্বাদের পানিফল পুষ্টিগুণসম্পন্ন খাবারের একটি চমৎকার উৎস।

পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্যগত উপকারিতা: পানিফল প্রায় চর্বিমুক্ত এবং পটাশিয়ামের একটি চমৎকার উৎস (৩৫০-৩৬০মিলিগ্রাম), যা মানব দেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ খনিজ এবং ডায়াবেটিস রোগীর জন্য একটি আদর্শ খাদ্য। প্রতি ১০০ গ্রাম পানিফলে শক্তি-৯৭ ক্যালরি, চর্বি- ০.১ গ্রাম, পটাশিয়াম-৫৮৪ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম-১৪ মিলিগ্রাম, শর্করা-২৪ গ্রাম, আমিষ-১.৪ গ্রাম এবং আঁশের পরিমাণ-২ গ্রাম, অ্যালুমিনিয়াম-১%, ভিটামিন সি ৬%, ভিটামিন বি-৬ ১৫% এবং ম্যাগনেসিয়াম ৫ %। শর্করা, খনিজ, ভিটামিন, ও আশসমৃদ্ধ পানিফল বিশেষ ভেষজ গুণাগুণসম্পন্ন হওয়ার কারণে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এটি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল। এটি থাইল্যান্ডের একটি জনপ্রিয় ডেজার্ট ট্যাবটিনক্রব-এর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ইন্দোনেশিয়াতে বিভিন্ন পানীয়র সঙ্গে এটি পরিবেশন করা হয়। ভারতে পানিফলের ময়দা পুরি, হালুয়া, রুটি, বরফি, বাটার ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। জুস, কেক তৈরিতে এটির ব্যবহার বহুল প্রচলিত। দেহের রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও পানিফলের ভূমিকা অপরিসীম।

পানিফল এন্টিঅক্সিডেটের একটি খুব ভালো উৎস- যা স্টেস প্রতিরোধের মাধ্যমে শরীরের দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ করে। কম ক্যালরি এবং বেশি আঁশযুক্ত হওয়ায় দেহের ওজন কমাতে সাহায্যে করে। গবেষণায় দেখা যায়, আঁশযুক্ত খাবার রক্তের চিনির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করে, কোলেস্টেরল কমায় এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। শরীর ঠান্ডা রাখতে সাহায্যে করে। যেহেত দেহের টক্সিক পদার্থ দূর করে; সেজন্য জন্ডিস রোগীদের খাদ্য তালিকায় পানিফল রাখা জরুরি। আয়োডিন খাবার কারণে থাইরয়েড সঠিক কার্যক্ষমতা বজায় থাকে। পানিফলের পর্যাপ্ত পটাশিয়াম, ভিটামিন 'বি' এবং 'ই' চুলপড়া রোধ করে।

বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট: পুষ্টিগুণসমৃদ্ধ এবং ভেষজগুণসম্পন্ন পানিফল দেশব্যাপী বেশি পরিচিত নয় বা অনেকে হয়তো চেনেই না। বাংলাদেশে এটি সিঙ্গারাফল হিসেবেও পরিচিত। গত কয়েক দশক যাবত বাংলাদেশে এর চাষাবাদ হলেও এটি শুধু চাষিদের উদ্যোগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানে সাতক্ষীরা, নওগাঁ এবং জামালপুর জেলায় পানিফলের বাণিজ্যিক চাষাবাদ হচ্ছে। বছরের বেশির ভাগ সময় যেসব জমি জলাবদ্ধ থাকে সেখানে অন্যান্য ফসল চাষ করা যায় না সেসব জমিই কৃষকরা বেছে নিচ্ছেন পানিফল আবাদের জন্য। কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় পানিফল আবাদের প্রতি কৃষকের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে।

বাংলাদেশে পানিফলের চাষাবাদ শুরু হয় ভাদ্র-আশ্বিন মাসে এবং ফল সংগ্রহ করা হয় অগ্রহায়ন থেকে পৌষ মাস পর্যন্ত। পানির গভীরতা ১-১.৫ ফুট থাকাকালীন পুকুর বা বিলে কৃষক পানিফলের চারা রোপণ করেন। এক চারা থেকে অন্য চারা দূরত্ব ১.৫-২ ফুট। অল্প খরচেই পানিতে এটি চাষাবাদ করা যায় বিধায় স্বল্প সময়ের মধ্যে পানিফলের চাষাবাদ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জলাশয়ে প্রতি বিঘায় পানিফল চাষে খরচ হয় ৪০০০-৫০০০ টাকা এবং প্রতি বিঘা থেকে লাভ হয় ২৫০০০-৩০০০০ টাকা। পানিফলে সাধারণত তেমন কোনো রোগবালাই দেখা যায় না। আমাদের দেশে অনেক পতিত এবং জলাবদ্ধ জমি রয়েছে। সেসব জমিকে যদি পানিফল চাষের আওতায় আনা যায় তাহলে পানিফল আমাদের কৃষি উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। এছাড়াও যেসব জমিতে পানিফল চাষাবাদ করা হয় সেসব জমি জলাবদ্ধতার কারণে নাবাদি পড়ে থাকে এবং একটি বাড়তি ফসল হিসেবে পাওয়া যায়। বর্তমানে শুধু শাসযুক্ত খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যদি এটি প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় তাহলে এর ভোক্তামূল্য দুই থেকে তিনগুন বর্ধিত হবে।

ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষিগবেষণা ইনস্টিটিউট, জয়দেবপুর, গাজীপুর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে