বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

কৃষিতে সৌরশক্তির ব্যবহারে উৎপাদন খরচ কমবে

মোহাম্মদ আফজাল হোসাইন
  ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০০:০০

গ্রীষ্মমন্ডলীয় দেশ হওয়ায় অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে সৌরশক্তির প্রাচুর্যতা রয়েছে। বাংলাদেশে সৌর আলোকে শক্তির মাত্রা প্রতিদিন বর্গমিটারে ৪.০ থেকে ৬.৫ কিলোওয়াট ঘণ্টা এবং প্রখর সূর্যালোকে প্রতিদিন ৬-৯ ঘণ্টার মধ্যে উঠানামা করে। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য সৌরশক্তি চালিত কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার উপযোগী। কৃষি যন্ত্রপাতি চালনায় সৌরশক্তির ব্যবহার করলে ধান উৎপাদন খরচ কমবে এবং খাদ্যে উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।

যেখানে বিদু্যৎ নেই, অথচ সেখানকার একটা সুবিশাল অঞ্চল সেচের আওতায় আনা দরকার, সে সমস্ত এলাকাতে ফসল উৎপাদনের জন্য সৌরপাম্প বসানো যেতে পারে। দেশের বিদু্যৎ ও জ্বালানি সংকটে সেচ সমস্যা সমধানের জন্য সৌরশক্তি চালিত সেচ পাম্প বিকল্প হতে পারে। এ উদ্দেশ্যে সরকার ২০১৬ সালের মধ্যে দেশে প্রায় ১৯ হাজার সৌর সেচ পাম্প স্থাপনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। বাংলাদেশে সেচের আওতায় জমির পরিমাণ প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ। অবশিষ্ট শতকরা ৪০ ভাগ জমি সেচ যন্ত্রের স্বল্পতা, জ্বালানি সংকট, বিদু্যতের অভাবসহ নানা কারণে সেচের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। বোরো ধানে উৎপাদনের প্রায় এক পঞ্চমাংশ বিদু্যৎ সেচের জন্য ব্যবহার হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ১৭ লাখ সেচ পাম্প রয়েছে, যার শতকরা ৮৩ ভাগ ডিজেল চালিত। প্রতি বছর প্রায় ৮০ কোটি লিটার ডিজেল সেচ কাজে ব্যয় হয়। সেচ মৌসুমে অতিরিক্ত জ্বালানি মূল্য কৃষকের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। সেচ পাম্প দ্বারা পুকুর বা খাল থেকে ভূগর্ভ থেকে পানি উঠিয়ে জমিতে দেওয়া যায়। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। সুতরাং সৌরপ্যানেল থেকে সর্বাধিক শক্তি পেতে হলে সৌরপ্যানেলটি দক্ষিণমুখী করে স্থাপন করতে হবে। সৌরপ্যানেল দুভাবেই স্থাপন করা হয়, নির্দিষ্ট ট্রেকার ও অটো ট্রেকারের সাহায্যে। বাংলাদেশের জন্য দক্ষিণমুখী করে ২৩.৫ ডিগ্রি আন্তঃকোণে প্যানেল স্থাপন করলে মোটামুটি সারা বছর ধরে বেশি সূর্যরশ্মি পাওয়া যায়।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), গাজীপুরে সৌরশক্তি দিয়ে কৃষি যন্ত্রপাতি চালানোর উপযোগিতা বিষয়ে এক গবেষণা চালানো হয়। কৃষি যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে ঝাড়াই যন্ত্র কম অশ্বশক্তি দিয়ে চালানো হয়ে থাকে বিধায় প্রাথমিকভাবে সৌরশক্তি দিয়ে ঝাড়াই যন্ত্র ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। এ জন্য ব্রি অটোমোবাইল ওয়ার্কশপের ছাদে ২০০ ওয়াট সৌরপ্যানেল বসিয়ে সৌরশক্তি সংগ্রহ করে ব্যাটারিতে সঞ্চয় করা হয়। এতে ০.৫ অশ্বশক্তি সম্পন্ন ডিসি মোটর, কানেকটার ব্যবহার করা হয়। এতে রয়েছে একটি চার্জ কন্ট্রোলার- যা অতিরিক্ত চার্জ বা অতিরিক্ত ডিসচার্জে ব্যাটারি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াকে চালু ও বন্ধ করার জন্য একটি একসেলারেটর ব্যবহার করা হয়। ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তি দিয়ে কোনরূপ বাধা ছাড়াই ঝাড়াই যন্ত্র প্রাথমিকভাবে আধাঘণ্টা চালানো হয়। এতে প্রতি ঘণ্টায় ৬০০-৮০০ কেজি ধান ঝাড়াই করা সম্ভব হয়। এর সাহায্যে ধান, গম ছাড়া অন্যান্য দানাদার শস্য ঝাড়াই করা যায়। শস্য সংগ্রহকালীন সময়ের পূর্বে ও পরে ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তি দিয়ে ১৫ ওয়াটের চারটি বাতি জ্বালানো হয়। সৌরপ্যানেল বসিয়ে সংগৃহীত সৌরশক্তি দুভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। সরাসরি সৌরশক্তি দিয়েও বাতি জ্বালানো যেতে পারে। এ শক্তি দিয়ে সাবমারসিবল পাম্পের সাহায্যে ভূ-উপরিস্থ পানি এবং ভূগর্ভস্থ পানি সেচ ও আবাসিক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। ব্যাটারিতে সঞ্চিত শক্তি দিয়ে যে কোনো ডিসি লোড ব্যবহার করা যায়।

বর্তমানে সৌরপ্যানেলের দাম উলেস্নখ্যযোগ্য হারে হ্রাস পাওয়ায় সৌর সেচপাম্প অথনৈতিকভাবে ব্যবহার উপযোগী হচ্ছে। এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানি বা এনজিও কর্তৃক সৌর পাম্প ব্যবহার হচ্ছে- যা সম্পূর্ণ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত। অধিকন্তু সৌর পাম্প দূষণমুক্ত এবং পরিবেশবান্ধব সেচ প্রযুক্তি। তাছাড়া সৌর পাম্প ব্যবহার নিশ্চিত ও ঝামেলা মুক্ত। ডিজেল চালিত পাম্প তেল, জ্বালানি, যন্ত্রাংশ ক্রয়, পরিবহণ ও ব্যবহারে ঝামেলা পোহাতে হয়। অপর পক্ষে সৌর পাম্প একবার স্থাপন করলে অনেক দিন ঝামেলামুক্তভাবে চালনা করা যায়। যে সব স্থানে বিদু্যৎ সংযোগ নেই বিশেষ করে চর এলাকায় সেচের জন্য এ পাম্পটি উপযোগী। সৌর পাম্পের প্রধান উপকরণ সৌরপ্যানেল, যার দাম অপেক্ষাকৃত কিছুটা বেশি হলেও এর জীবনকাল ২৫ বৎসর। সৌর পাম্প চালাতে কোনো প্রকার জ্বালানি লাগে না। একই সোলার পাম্প হতে প্রাপ্ত সৌরশক্তি সেচ মৌসুমে সেচ প্রদানে, শস্য সংগ্রহকালে ঝাড়াই, অন্য সময়ে পানি উত্তোলন ও বাতি জ্বালানোর কাজে ব্যবহার করা যায়। খুবই নগণ্য মেরামত খরচ, দীর্ঘ জীবনকাল ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় সৌর সেচ পাম্প ভবিষ্যতে ডিজেল চালিত সেচ পাম্পের জায়গা জুড়ে নেওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।

মোহাম্মদ আফজাল হোসাইন, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), গাজীপুর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে