শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ছাগল পালনে লাকির সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে

আলতাব হোসেন
  ০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

লাকি দে একজন মধ্য বয়সি নারী। সংসারে অভাব ছিল নিত্যদিনের। ছয় সদস্যের পরিবারে তার স্বামী রাজিব দে ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। চা বিক্রি করে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। অভাব-অনটনে মেয়েটাকে স্কুলে পাঠাতে পারেননি। একবেলা খেয়ে, আরেক বেলা না খেয়ে দিন কাটছিল তাদের। ভিটেমাটি ছাড়া ছিল না কোনো ফসলি জমি। হাত গুটিয়ে বসে থাকা ছাড়া আয়ের আর কোনো উৎস ছিল না।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির রাঙ্গাপানির হাজিরখীল গ্রামের লাকি দে অনেক চেষ্টা করেও সংসারের উন্নতির জন্য বাড়তি আয়ের কোনো উৎস খুঁজে পাননি। পরিবারের কষ্টের সীমা ছিল না। তবু লাকি দে ভেঙে পড়েননি। গায়ে- গতরে খেটে কয়েটি হাঁস-মুরগি কিনেন লাকি দে। সহায় সম্বল বলতে তার তিনটি হাঁস আর চারটি মুরগি। এ দিয়ে সংসারের চাকা ঘুরে না তার। এক সময় বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া কানের দুল বিক্রি করে একটা পাঁঠার বাচ্চা কিনেন লাকি দে। পাহাড়ি এলাকায় চারণ ভূমির সুবিধা থাকলেও সঠিক নিয়মে ছাগল পালন সম্পর্কে জানা ছিল না লাকি দে'র। সনাতন পদ্ধতি যেমন ছাগল সকালে মাঠে চলে যেত আর সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে আসত। এছাড়া ছাগলের প্রতি আলাদা কোনো যত্ন নিতেন না।

একদিন লাকিদের সঙ্গে হাজিরখীল উড়াং পাড়ার পাহাড়িকা দলের সভানেত্রী শ্রাবনীর সঙ্গে কথা হয়। শ্রাবনী তাকে জানান, 'মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালন করলে লাভবান হওয়া সম্ভব। স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ছাগল পালন প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে ঋণ করে লাকি দে আরও দুইটি ছাগল ও একটি পাঁঠা কিনেন। লাকি দে চারটি ছাগল দিয়ে লাকি খামারের যাত্রা শুরু করেন।

লাকি দে বলেন, প্রশিক্ষণ থেকে ছাগলের পিপিআর রোগ, পেটফোলা, চর্মরোগ, কৃমিজনিত সমস্যার লক্ষণ- প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানতে পারেন। লাকি দে আগে ছাগলকে শুধু মাঠের ঘাস ছাড়া কোনো দানাদার খাদ্য দিতেন না। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে লাকি দে ছাগল পালনে সচেতন হন। পাঁঠা, খাসি, ও ছাগিকে আলাদাভাবে কাঁচা ঘাসের পাশাপাশি দনাদার খাদ্য যেমন- ভুট্টাভাঙা, ডালের ভুসি, গমের ভুসি, ছোলা ও লবণ দিচ্ছি। এতে ছাগলের স্বাস্থ্যের দ্রম্নত উন্নতি হয়েছে। পাঁঠা ছাগল মোটাতাজাকরণের জন্য দানাদার খাদ্যের পাশাপাশি ইউরিয়া মোলাসেস খাওয়াতেন। আগে ছাগলের স্বাস্থ্য ভালো না থাকার কারণে ছাগল বিক্রি করে ভালো দাম পাওয়া যেত না। এখন লাভে পাঁঠা বিক্রি করে থাকি। স্বল্প পুঁজি নিয়ে ছাগল প্রজনন কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে বর্তমানে লাকির সংসারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে।

হার না মানা নারী লাকি দে জানান, তার খামারে বাক সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। বাক সার্ভিস সেন্টারে ভালোজাতের পাঁঠা আছে দুইটি। আশপাশের গ্রামে পাঁঠা ছাগল প্রজননের সার্ভিস দিয়ে বাড়তি কিছু আয় হয়। তা দিয়ে পাঁঠার খাবারের দাম ওঠে আসে। আর পূজায় পাঁঠার ভালো দাম পাওয়া যায়। হাজিরখীল গ্রামে ছাগলের বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকার কারণে পাইকার ছিল না। ছাগল বিক্রয়ে অসুবিধা হতো, অনেক সময় ন্যায্যমূল্য পাওয়া যেত না। এ প্রকল্পের মাধ্যমে হাজিরখীল এলাকার সব ছাগল ব্যাপারীদের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করে দেওয়া হয়েছে। পাইকাররা এখন নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। ছাগল বিক্রি করে উপযুক্ত মূল্য পাচ্ছি। এখন আর হাটে যেতে হয় না, বেপারিরাই নিয়মিত আসেন। তিনি জানান, এখন মাংস বিক্রেতা, খাদ্য বিক্রেতা, ওষুধ বিক্রেতারা বাড়ি বাড়ি আসেন।

সফল নারী উদ্যোক্তা লাকি দে বলেন, আগে নিউমোনিয়া, পিপিআর, পেটফোলা, চর্মরোগ আর সবচেয়ে বেশি কৃমির সমস্যার কারণে ছাগল পালন করেও বেশি লাভ করতে পারিনি। প্রকল্পের মাধ্যমে কৃমিনাশক ও ভ্যাক্সিন ক্যাম্প করার ফলে পুরো এলাকা জুড়ে পিপিআর রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। আমার খামার এখন নিরাপদ। তিনি গর্ব করে বলেন, চারটি ছাগল দিয়ে শুরু করে ছিলাম। এখন ২৪টি। এর বাইরে ১৮টি ছাগল বিক্রি করে এক লাখ ২৭ হাজার টাকা আয় করেছি। ছাগলের খামার থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে সংসার ও চায়ের দোকান এখন অনেক বড় করেছি। সংসারের অভাব এখন আর নেই। স্বামী আর আমি মিলে দুইজনে সংসার থেকে অভাব দূর করেছি।

ফটিকছড়ি উপজেলার লাইফস্টক কমকর্তা ডা. দেলোয়ার হোসেন জানান, প্রশিক্ষণে ছাগল পালনকারীদের হাইড্রোফনিক (মৃত্তিকাবিহীন জল চাষ বিদ্যা) ফডার নামের আধুনিক প্রযুক্তিতে পশুখাদ্য উৎপাদন শেখানো হয়েছে। এই খাদ্যে বাজারের দানাদার ও মাঠের সবুজ ঘাসের প্রায় সব পুষ্টি উপাদান আছে। এই প্রযুক্তিটি গমবীজ দিয়ে ব্যবহার করছেন। তিনি জানিয়েছেন, গম এবং ভুট্টাবীজ দিয়ে চাষ করে দেখা গেছে গমবীজ দিয়ে চাষ করলে সময় কম লাগে আর ভুট্টাবীজ দিয়ে বেশি সময় লাগে। এই প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে ছাগলকে নিয়মিত ঘাস খাওয়াচ্ছেন লাকি দে।

লাকি স্বামী রাজিব দে জানান, প্রশিক্ষণে ছাগল পালন বিষয়ে অনেক অজানা তথ্য জানতে পারি। প্রশিক্ষণের আগে পারুল ধর ঘরের বাহিরে মাটিতে ছাগল পালন করত। প্রতিদিন সকালে পরিষ্কার করত না, ফলে অনেক দুর্গন্ধ সৃষ্টি হতো। মাচা পদ্ধতিতে ছাগল পালনের জন্য ঘর তৈরি করি। পূর্বে মলমূত্র এবং আবর্জনা থেকে ছাগলের অনেক রোগবালাই হতো, কিন্তু বর্তমানে মাচার উপরে ছাগল পালনের কারণে এসব রোগবালাই থেকে রক্ষা পাচ্ছি। মাচায় ছাগল রাখার কারণে ছাগলের ঘরের ভেতর পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশ করে ফলে দুর্গন্ধ থাকে না। মলমূত্র মাচার নিচে পড়ে যায়, এবং মলমূত্রগুলো জৈবসার হিসেবে জমিতে ব্যবহার করা যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে