আধুনিক ও স্মাটর্ জাপানের কৃষি

প্রকাশ | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ০০:০০

এম আর সাঈদ
নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে জাপানে ধানচাষ ছবি : ইন্টারনেট
প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ জাপান। ব্যাপক শিল্পায়নসহ নানাবিধ কারণে বতর্মানে এখানকার আবাদযোগ্য ভ‚মি মাত্র ১৩ শতাংশ। এর মধ্যে আবার বড় একটি অংশ অবস্থিত পাহাড়ি খাড়া অঞ্চলে। সেখানে ধান বা অন্যান্য ফসল উৎপাদন করতে হয় টেরেস ফামির্ং পদ্ধতিতে (পাহাড়ি জমি তাকের মতো স্তরে স্তরে কেটে সেখানে ফসল ফলানো পদ্ধতি)। তবে এখানকার আবহাওয়া বরাবরই ছিল চাষাবাদের অনুক‚লে। পাশাপাশি পযার্প্ত বৃষ্টিপাত, জমির বাড়তি উবর্রাশক্তি ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আবাদযোগ্য স্বল্প জমিতেই ব্যাপক নিবিড় আকারে শস্য উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছে জাপান। আবাদযোগ্য ভ‚মির পরিমাণ যত কমই হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে জাপানের প্রতিটি অংশেই কৃষির উপস্থিতি দেখা যাবে। দেশটির কৃষিতে উত্তরাঞ্চলীয় দ্বীপ হোক্কাইডোর এক বিশেষ অবস্থান রয়েছে। জাপানের মোট কৃষি উৎপাদনের ১০ শতাংশই আসে হোক্কাইডো থেকে। পৃথিবীর অন্যান্য এলাকার মতো জাপানের কৃষকদেরও একসময় প্রচÐ দারিদ্র্য আর অনটনে দিন কাটাতে হয়েছে। বিশেষ করে সামন্ত যুগের শেষ পযাের্য় এসে জাপানজুড়ে যে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়, তার ঝড়ঝাপটা সেখানকার কৃষকদের ওপর দিয়েই বয়ে গেছে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালেও অভাব-অনটন আর দারিদ্র্য ছিল জাপানের কৃষকদের নিত্যসঙ্গী। সে সময়ও দেশটির কৃষিজমির পুরোটাই কুক্ষিগত ছিল গোটাকতক জমিদার ও সামন্ত ভ‚স্বামীর হাতে। এসব জমিদার ও সামন্ত ভ‚স্বামী রাজনৈতিকভাবে বেশ ক্ষমতাবান ছিল। এদের অত্যাচার আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে অসংখ্যবার বিদ্রোহ করেছেন জাপানের কৃষকরা। পরিস্থিতির বদল ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। মহাযুদ্ধে জাপান হেরে গেলেও দেশটির কৃষকদের জন্য তা শাপে বর হয়ে ওঠে। ১৯৪৬-৫২ সাল পযর্ন্ত জাপানে দখলদারিত্ব বজায় রাখার পাশাপাশি দেশটির অথৈর্নতিক পুনগর্ঠন কাযর্ক্রমে হাত দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ম্যাকআথার্র প্রশাসনের অধীনে সে সময় যে কয়টি ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, তার মধ্যে একটি ছিল কৃষি সংস্কার কমর্সূচি। জাপানের ক্ষুদ্র চাষিরা এ সংস্কার কমর্সূচির পূণর্ সুফল ভোগ করেছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জাপানের আগ্রাসী ভ‚মিকার পেছনে সেখানকার সামন্ত ও জমিদারদের ব্যাপক ভ‚মিকা ছিল। মহাযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর দেশটিতে ঘঁাটি গেড়ে বসল মাকির্ন নেতৃত্বাধীন মিত্র বাহিনী। সামন্ত ও জমিদারদের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার উদ্যোগ নিল দখলদার ম্যাকআথার্র প্রশাসন। অথৈর্নতিক সংস্কার কাযর্ক্রমের অংশ হিসেবে জাপান সরকারকে দিয়ে মোট কৃষিজমির দুই-তৃতীয়াংশ কম দামে কিনিয়ে নেয়া হলো। এরপর তা কম দামেই বিক্রি করে দেয়া হলো ক্ষুদ্র কৃষকদের কাছে। ম্যাকআথার্র প্রশাসনের এ সংস্কার কাযর্ক্রম জাপানের ক্ষুদ্র কৃষকদের ভাগ্য ফিরিয়ে দিল। যদিও অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির কারণে শুরুর দিকে তাদের মুনাফা সীমিত হয়ে পড়েছিল। সংস্কারের আগে জাপানে মোট কৃষিজমির মাত্র ২৩ শতাংশের ওপর মালিকানা ছিল কৃষকের। সংস্কার কাযর্ক্রমের বদৌলতে ১৯৮০ সালের দিকে এসে দেখা গেল, দেশটির মোট কৃষিজমির পুরোটাই চলে গেছে কৃষকের মালিকানায়। তবে এরও কিছু নেতিবাচক দিক ছিল। জমিদারি প্রথা যাতে কোনোভাবে ফিরে আসতে না পারে, সংস্কারের কালে সেজন্য কৃষিজমির মালিকানার ওপর সীমা আরোপ করা হয়েছিল। অথার্ৎ কারও পক্ষে নিদির্ষ্ট পরিমাণ ভ‚মির অতিরিক্ত কৃষিজমির মালিক হওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে দীঘর্ ৫০ বছর ধরে জাপানের কৃষিতে বেসরকারি করপোরেশনগুলোর বৃহদায়তন বিনিয়োগের কোনো সুযোগ ছিল না। পাশাপাশি প্রতিযোগীর অভাবে জাপানের বৃহত্তম কৃষক সমিতি নোকিয়োর (ইংরেজি নাম জাপান এগ্রিকালচার বা জেএ) একচেটিয়া কতৃের্ত্ব চলে যায় দেশটির কৃষি খাত। একই সঙ্গে শক্তিশালী লবি ও প্রেসার গ্রæপ হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে এ কৃষক সমবায় প্রতিষ্ঠান। পরিস্থিতিতে বদলের সূচনা দেখা দেয় ১৯৯৪ সালের দিকে। জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেডের (গ্যাট) অধীনে আয়োজিত উরুগুয়ে সম্মেলনের পর থেকেই জাপানের কৃষিতে আরেক দফা পরিবতের্নর হাওয়া বইতে থাকে। এরপর ১৯৯৯ সালের মৌলিক কৃষি আইনের অধীনে যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলোকে কৃষিতে বিনিয়োগের অধিকার দেয়া হয়। ওই আইনে বলা হয়, কৃষকের নেতৃত্বাধীন উৎপাদন প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় ২৫ শতাংশ পযর্ন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলো। এরপর ২০০৯ সালের সংশোধিত কৃষিভ‚মি আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কৃষিজমি ভাড়া করে কৃষিকাজের (মালিকানায় নয়) অধিকার দেয়া হয়। সা¤প্রতিক কালে শিনজো আবের সরকার যৌথ মূলধনি কোম্পানিগুলোর জন্য কৃষিতে বিনিয়োগের সূযোগকে আরও শিথিল করে দিয়েছে। অকৃষি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কৃষিতে ম‚লধনি বিনিয়োগের সীমা ২৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ শতাংশে তুলে নেয়া হয়েছে। কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক বোডের্ কৃষকের সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়েছে। আবে সরকারের এ উদ্যোগের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবেই হাতে পাওয়া যায়। শিনজো আবে ক্ষমতায় আসেন ২০১২ সালে। ২০১৪ সালের মধ্যে জাপানে কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দঁাড়ায় ১৪ হাজারের বেশিতে। রাতারাতি দেশটিতে এ ধরনের কৃষি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যায়। ২০১৪ সালেই কৃষি উৎপাদনে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দঁাড়ায় এর পঁাচ বছর আগের অথার্ৎ ২০০৯ সালের তুলনায় সাড়ে ২৯ শতাংশ বেশিতে। পরবতীর্ সময়ে দেশটির কৃষিতে পরিবতের্নর সবচেয়ে জোরালো পদধ্বনি শোনা যায় ২০১৬ সালের মে মাসে। সে সময় দেশটির ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক স্পেশাল জোন আইনে পরিবতর্ন আনা হয়। এর আওতায় বেসরকারি খাতের করপোরেশনগুলোকে ইয়াবু শহরাঞ্চলের কৃষিজমির শতভাগ মালিকানা গ্রহণের সুযোগ দেয়া হয়। এত কিছুর পরও জাপানের কৃষি খাত দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। দেশটির কৃষি, বনায়ন ও মৎস্যসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে জাপানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কৃষিকাজে নিয়োজিত খানার সংখ্যা ছিল ১৩ লাখ ৩০ হাজার। ১৯৬৫ সালেও দেশটিতে কৃষকের সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১০ লাখ। ৫০ বছরের ব্যবধানে ২০১৫ সালে তা নেমে আসে ২০ লাখেরও নিচে। দেশটির কৃষি খাতে এখন দুশ্চিন্তার আরেক বড় কারণ হয়ে দঁাড়িয়েছে কৃষকদের বয়সও। জাপানের কৃষি খাতে এ মুহূতের্ বয়স্ক ও বৃদ্ধ কৃষকের সংখ্যাই বেশি। তথ্যমতে, দেশটির প্রতি ১০ জন কৃষকের মধ্যে ছয়জনেরই বয়স এখন ৬৫ বছরের বেশি। অন্যদিকে তরুণদের মধ্যেও এখন কৃষিকে সাবর্ক্ষণিক পেশা হিসেবে গ্রহণে অনীহা দেখা যাচ্ছে। তবে এর মধ্যেও আশার আলো দেখাচ্ছে কৃষিতে করপোরেট অংশগ্রহণের মাত্রা বৃদ্ধি ও ব্যাপক যন্ত্রায়ন। বেশকিছু প্রতিষ্ঠান দেশটির কৃষি ও কৃষিপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগে এগিয়ে এসেছে। বৃহদায়তনে ধান ও সবজি উৎপাদন এবং বিনিয়োগে নিয়োজিত রয়েছে ইয়োন সুপারমাকের্ট চেইন, লসন, সেভেন অ্যান্ড আই হোল্ডিংস ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান। জাপানের কৃষি উৎপাদন খাতে তথ্যপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগের দিক থেকে অগ্রণী প্রতিষ্ঠান হলো ফুজিৎসু। ২০১২ সালে ক্লাউডভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থাপনা সেবা আকিসাই চালুর মাধ্যমে এ খাতে পা রাখে ফুজিৎসু। বতর্মানে ইয়োনের ফামির্ং ডিভিশনসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান আকিসাইয়ের গ্রাহক। এ ছাড়া এ খাতে বিনিয়োগ রয়েছে এনইসি, হিটাচি, তোশিবা ও টয়োটার মতো জায়ান্ট প্রতিষ্ঠানগুলোরও। কানসাই অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে ‘প্যাসিভ হাউস’ নামে প্যানাসনিক উদ্ভাবিত এক ধরনের গ্রিনহাউস ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। প্যানাসনিকের ইন্ডাস্ট্রিয়াল সিস্টেমস বিভাগ ও হাউজিং সিস্টেমস বিভাগ যৌথভাবে এ গ্রিনহাউস উদ্ভাবন করেছে। এতে চাষাবাদের জন্য প্রয়োজনীয় আলো, তাপমাত্রা ও আদ্রর্তার কোনো ব্যত্যয় ঘটলেই সেন্সরে তা ধরা পড়ে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা সমন্বয় হয়ে যায়। কৃষি যন্ত্রপাতি নিমার্তা প্রতিষ্ঠান কুবোতা স¤প্রতি এর প্রত্যক্ষ কৃষি কাযর্ক্রম আরও বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে। মূলত গবেষণা ও উন্নয়ন কাযর্ক্রমের খাতিরেই কৃষিকাজে সংশ্লিষ্টতা তৈরি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চারটি খামারে এ কাযর্ক্রম শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালের মধ্যে এ ধরনের খামারের সংখ্যা ১৫তে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে কুবোতা। সব মিলিয়ে প্রতিষ্ঠানটির আওতাধীন কৃষিজমির পরিমাণ এক হাজার হেক্টর। এ ছাড়া কৃষি যন্ত্রপাতিতে জিপিএস, সেন্সর ও ড্রোনের ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ নিশ্চিতে টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান এনটিটির সঙ্গে অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছে কুবোতা। চলতি বছরের মধ্যেই স্বচালিত কৃষি যন্ত্রপাতি বাজারে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। মূলত যেসব তরুণ কৃষকের কৃষিকাজে অভিজ্ঞতা কম, তাদেরই পণ্যটির জন্য ‘টাগের্ট মাকের্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। কিয়োটোভিত্তিক স্টাটর্আপ মাইফামের্র সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে জাপানের জাতীয় পযাের্য় কৃষিজমি বিক্রি বা ভাড়াসংক্রান্ত ডাটাবেজ গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে আরেক টেলিকমিউনিকেশন প্রতিষ্ঠান সফটব্যাংক। শিনজো আবের সবের্শষ সংস্কার এ ধরনের অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের জন্য কৃষিতে বিনিয়োগের পথ খুলে দিয়েছে। এ ছাড়া ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক সব পযাের্য়র কৃষিতে প্রযুক্তির সবোর্চ্চ ব্যবহার হচ্ছে। ফলে দেশটির কৃষিতে সংকোচনের যে কালো ছায়া দেখা দিয়েছে, তা সাময়িক বলে মনে করছেন অনেকে। এ ছাড়া জাপানে ভাটির্ক্যাল ফামির্ং পদ্ধতিও ইদানীং বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সনাতন পদ্ধতিতে কৃষি জমির পাশাপাশি সারি বেঁধে বপন ও রোপণের মাধ্যমে শস্য ও সবজি ফলানো হয়। একে বলা হয় হরাইজন্টাল বা আনুভ‚মিক কৃষি পদ্ধতি। কিন্তু ভাটির্ক্যাল ফামির্ং বা উল্লম্ব পদ্ধতিতে গ্রিনহাউসে একের পর এক তাকে শস্য বা সবজি ফলানো হয়। বিশেষ করে কিয়োটো ও টোকিও অঞ্চলে এ ধরনের চাষ পদ্ধতির প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। ২০ বছর আগেই, অথার্ৎ ১৯৯৮ সালের দিকেই জাপানে চালু ছিল ২০ লাখেরও বেশি ট্রাক্টর। কম্বাইন হারভেস্টার চালু ছিল ১২ লাখেরও বেশি। জাপানে এসব যন্ত্রও এখন সেকেলে হয়ে পড়েছে। কৃষি ও কৃষিপ্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগের দুয়ার খুলে দিয়ে দেশটির কৃষিকে করে তোলা হয়েছে আধুনিক থেকে আধুনিকতর ও স্মাটর্। অন্যান্য শিল্পের ব্যাপক অগ্রগতির কারণে জাপানের অথর্নীতিতে কৃষি এখন অত্যন্ত গৌণ একটি খাত, এ কথা সত্যি। কিন্তু এর পরও বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয় একটি জায়গা হতে পারে জাপানের কৃষি খাত।