মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

কলা চাষে বদলে যাচ্ছে চরাঞ্চলের মানুষের জীবনধারা

আলতাব হোসেন
  ২০ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

'কলা রোয়ে না কেটো পাত- তাতেই কাপড় তাতেই ভাত' কলা যে লাভজনক একটি অর্থকরী ফসল খনার বচন থেকেই তা বুঝা যায়। কলা বাংলাদেশের একটি জনপ্রিয় ফল। অন্যান্য ফলের তুলনায় এটি সস্তা, সহজলভ্য এবং সারা বছরই পাওয়া যায়। দাম কম থাকায় ধনি-গরিব মানুষ কমবেশি ১২ মাসই কলা খাওয়ার সুযোগ পান। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৫৮ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে ১২ লাখ ৪ হাজার ৫২০ টন কলা উৎপন্ন হয়। সারাদেশে কলার চাষ হলেও ময়মনসিংহ, ঢাকা, টাঙ্গাইল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, জয়পুরহাট, রাজশাহী, নাটোর, পাবনা ও যশোর জেলায় বাণিজ্যিকভাবে কলার চাষ করা হয়।

কুড়িগ্রামের নিষ্ফলা চরভূমিতে এখন বাণিজ্যিকভাবে কলাচাষ করা হচ্ছে। আবাদ ভালো হওয়ায় বদলে যাচ্ছে চরবাসীর চিরচেনা কষ্টের জীবন। সেই সঙ্গে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কলা বেচাকেনায় গড়ে উঠেছে বিরাট কলার হাট। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কলা কিনতে এই হাটে আসছেন বেপারি-পাইকার-মহাজনরা। ফলে এই হাট ঘিরে হয়েছে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান।

জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত ধরলা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা ও দুধকুমারসহ ১৬ নদনদীর বুকজুড়ে এবং দুপাড়ে রয়েছে বিশাল ধু-ধু বালুচর। আগে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কাশ এবং ফাঁকে ফাঁকে ঝাউবন ছাড়া কিছুই চোখে পড়ত না। নিষ্ফলা এই জমিতে ফসল বলতে ছিল কাউন আর চিনা। তাও কোনোবার হতো, কোনোবার হতো না। লাভের খাতা থাকত শূন্য। মাত্র বছর চারেক আগেও এই দৃশ্যই চোখে পড়ত। এখন চরগুলোতে সবুজের সমারোহ। বাণিজ্যিকভাবে করা হচ্ছে অমৃতসাগর, কবরি, সবরি, চাঁপা, বিচি ও কাবলি কলার চাষ।

ধরলা পাড়ের সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নে কলার চাষ হচ্ছে বেশি। শহর লাগোয়া মাধবরাম থেকে শুরু করে উত্তর দিকের আরাজী পলাশবাড়ী, সুভারকুটি, চর সুভারকুটি, মাস্টারের হাট, হেমের কুটি, হলোখানা, চর হলোখানা, চর সারোডোব, সারোডোব ও ছাট কালুয়াসহ ছোটবড় সব চরে এখন কলাচাষ করা হচ্ছে। যাদের আর্থিক সামর্থ্য আছে এমন চরবাসী নিজেরাই নেমেছেন কলা চাষে। আবার অনেক পাইকার-বেপারি-মহাজন জমি লিজ নিয়ে কলার বাগান করেছেন।

আরাজী পলাশবাড়ী গ্রামের ফতেহ আলী জানান, তিনি এক একর জমি লিজ দিয়েছেন বছরে ২০ হাজার টাকা চুক্তিতে। অথচ এই জমি থেকে আগে ৫ হাজার টাকার ফসলও ঘরে তুলতে পারেননি। এই গ্রামেরই কয়ছার আলী নিজের এক একর জমিতে ১ হাজার কলার গাছ লাগিয়েছেন। খরচ গেছে ৫০ হাজার টাকা। এবার এই ক্ষেতের কলা বিক্রি করেছেন ৯০ হাজার টাকা। এভাবে হেমেরকুটি গ্রামের শফিকুল ৫ একর, আবদুস সামাদ ২ একর এবং আব্দুর রহমান ২ একর জমিতে কলাচাষ করে মোটা অঙ্কের লাভ ঘরে তুলেছেন। হেমেরকুটি গ্রামের হামিদ সরকার জানান, তিনি আট একর জমিতে অমৃতসাগর এবং ১২ একর জমিতে সবরি কলাচাষ করেছেন। ব্যয় হয়েছে প্রায় ১২ লাখ টাকা। এখনো সব কলা বিক্রি শেষ হয়নি। তিনি আশা করছেন, এবার কলা বিক্রি করে ৫ লাখ টাকা লাভ করবেন।

এখানকার উৎপাদিত কলা বেচাকেনার জন্য জেলা শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে কুড়িগ্রাম-রংপুর মহাসড়কের পাশে কাঁঠালবাড়ীতে গড়ে উঠেছে কলার হাট। সপ্তাহের সোম ও শুক্রবার বসছে হাট। জমি থেকে কলা কিনে এনে এই হাটে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন অনেক পাইকার-বেপারি। আবার জেলার বাইরে থেকে আসা পাইকার- বেপারি ও মহাজনরা এখানকার কলা কিনে নিয়ে যাচ্ছেন ঢাকা, বগুড়া ও রংপুরসহ ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বগুড়া থেকে আসা পাইকার হিরা জানান, তিনি এই হাট থেকে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকায় যে কলা কিনছেন তা বগুড়ায় বিক্রি হচ্ছে ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার টাকায়। এছাড়া জেলার বাজারগুলোর কলার চাহিদাও মিটছে এই হাট থেকে। বর্তমানে কলার বাগানে কাজ করা, হাটে কলা আনা এবং ফেরি করে পাকা কলা বিক্রি করার কাজে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

এ বিষয়ে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, এ বছর জেলার ৯ উপজেলায় ৫০০ হেক্টর জমিতে কলার চাষ হয়েছে। এর মধ্যে ২৫০ হেক্টরই চাষ হয়েছে সদর উপজেলায়। ফলন ভালো হয়েছে। দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। ফলে চাষিদের কলা চাষে আগ্রহ বাড়ছে। এতে নিষ্ফলা চরভূমিগুলো ক্রমেই আবাদি হয়ে উঠছে। এছাড়া কলার আবাদ ও বাজারজাত করার কাজে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।

কলার উপকারিতা : কলাকে বলা হয় নানা রোগের প্রাকৃতিক ওষুধ। কলা হতাশা কমায়, মুড ভালো রাখে, রক্তশূন্যতা রোধ করে, উচ্চ রক্তচাপ, কোষ্ঠকাঠিন্য, বুক জ্বালাপোড়া কমায়। কলা খেলে মাইগ্রেনের ব্যথা অনেকটা উপশম হয়। বিশেষজ্ঞরা জানান, পর্যাপ্ত পটাশিয়াম থাকায় কলা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন ৩টি করে কলা খেলে স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি হ্রাস পায় শতকরা ২১ ভাগ। কলার ভিটামিন বি-৬ রক্তের শকরা নিয়ন্ত্রণ করে। কলা প্রাকৃতিক এন্টাসিডের মতো কাজ করে। এছাড়া কলায় প্রচুর পরিমাণে আয়রন, ফসফরাস ও ভিটামিন-এ রয়েছে।

জাত নির্বাচন : বাংলাদেশে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ জাতের কলার চাষ হয়ে থাকে। এগুলোর মধ্যে অমৃত সাগর, সবরি, কবরি, চাঁপা, মেহেরসাগর, কাবুলি, বিচিকলা ও আনাজি কলা উলেস্নখযোগ্য। সম্প্রতি বারিকলা-১, বারিকলা-২, বারিকলা-৩ ও বারিকলা-৪ নামের চারটি উচ্চ ফলনশীল কলার জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। এসব জাতের মধ্যে বারিকলা-১ এরই মধ্যে চাষিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। বারিকলা-১ একটি উচ্চ ফলনশীল জাত, পাকা কলার রঙ উজ্জ্বল হলুদ, খেতে বেশ সুস্বাদু। বারিকলা-২ তরকারি খাওয়ার উপযোগী একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। গাছ তুলনামূলকভাবে খাটো আকৃতির। বারিকলা-৩ একটি উচ্চ ফলনশীল জাত। দেখতে অনেকটা বাংলাকলা বা কবরি কলার মতো। বারিকলা-৩ উচ্চ ফলনশীল একটি চাঁপাকলার জাত।

মাটি : পর্যাপ্ত রোদযুক্ত ও পানি নিষ্কাশনের সুবিধাসম্পন্ন উঁচু দো-আঁশ এবং বেলে দো-আঁশ মাটি কলা চাষের জন্য উপযুক্ত।

রোপণ সময় : দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে কলার চারা রোপণ করা হয়। আশ্বিন থেকে কার্তিক, মাঘ থেকে ফাল্গুন এবং চৈত্র থেকে বৈশাখ- এ তিন সময়েই কলার চারা রোপণ করা যায়। তবে আশ্বিন-কর্ার্তিক মাসে রোপণ করা কলাগাছে বেশি ফলন পাওয়া যায়।

জমি তৈরি ও গর্ত খনন : কলা চাষের জন্য নির্বাচিত জমি ভালোভাবে ও গভীর করে চাষ করতে হবে। দুই মিটার দূরে দূরে ৬০ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্য, ৬০ সেন্টিমিটার প্রস্থ ও ৬০ সেন্টিমিটার গভীর করে গর্ত করতে হবে। চারা রোপণের ১৫ দিন আগেই গর্ত খনন করা উচিত।

চারা রোপণ : চারা রোপণের জন্য অসি তেউড়ই উত্তম। অসি তেউড়ের পাতা সরু, সুচালো অনেকটা তলোয়ারের মতো। গোড়ার দিক মোটা এবং আগার দিক সরু। তিন মাস বয়সের সুস্থ-সবল রোগমুক্ত বাগান থেকে তেউড় সংগ্রহ করতে হবে। রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ থেকে গাছকে রক্ষার জন্য ১০০ লিটার পানিতে ১০০ গ্রাম ব্যাভিস্টিন মিশিয়ে সেই দ্রবণে চারার গোড়ার অংশ আধা ঘণ্টা শোধন করে নেয়া উচিত। রোপণের জন্য সাধারণত ৫০ সেন্টিমিটার লন্বা তেউড় ব্যবহার করা উচিত। রোপণের সময় চারা গোড়ার কাটা অংশটি দক্ষিণ দিকে ফেলতে হবে, যাতে কাঁদিটি উত্তর দিকে বের হয়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে