হুমকিতে মানবস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য

কৃষিতে বালাইনাশক ব্যবহার

প্রকাশ | ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

কৃষিবিদ ইমরান সিদ্দিকী
শাকসবজিকে রোগ ও পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য কৃষক প্রতিনিয়ত যথেচ্ছভাবে যত্রতত্র মাত্রাহীন পরিমাণে বিভিন্ন প্রকার কীটনাশক ব্যবহার করে যাচ্ছেন। কীটনাশক বা বালাইনাশক হলো বিষাক্ত পদার্থ- যা মানুষ, পশুপাখি, কৃষি, পরিবেশ, বাতাস, পানি, মাটি, আবহাওয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। প্রতি বছর দেশে ৩০ হাজার টনেরও বেশি কীটনাশক আমদানি করা হয়। ডিডিটি ও ক্লোরিন গ্রম্নপের কীটনাশক দেশে নিষিদ্ধ হলেও চোরাই পথে এসব আসে অবাধে এবং ব্যবহার করা হয় বিপদের কথা না জেনে। জনবহুল দেশের খাদ্য চাহিদা মেটাতে শস্য নিবিড়তা ক্রমেই বাড়ছে এর সঙ্গে পালস্না দিয়ে বাড়ছে কীটনাশকের ব্যবহার কৃষকদের প্রশিক্ষণের অপর্যাপ্ততা এবং অদক্ষতার কারণে ফসলে ব্যবহৃত কীটনাশকের বিষ মানবদেহে ঢুকে রক্তে মিশছে। কৃষি ফসল ও খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থে কীটনাশকের অপব্যবহার কমানো জরুরি। এজন্য প্রয়োজন আইনের শাসন, কঠোর নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু তদারকি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, খুব অল্পসংখ্যক কৃষকই বালাইনাশক ও কীটনাশক এর যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন। কৃষকদের অধিকাংশই বালাইনাশক কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ও স্থানীয় কীটনাশক ব্যবসায়ীদের পরামর্শে ফসলে সার-কীটনাশক ব্যবহার করে- যা অধিকাংশ সময়ই মাত্রাতিরিক্ত হয়। বাংলাদেশ ক্রপ প্রোটেকশন অ্যাসোসিয়েশন (বিসিপিএ) সূত্রের হিসাবে, গত বছরে ২০ কোটি ৩৮ লাখ টাকার কীটনাশক আমদানি হয়েছে। আরেকটি সূত্রের দাবি, বৈধভাবে আমদানির সঙ্গে ভারত এবং চীন থেকে বছরে আরো প্রায় ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকার কীটনাশক অবৈধ পথে দেশে ঢুকে ব্যবসায়ীদের হাত হয়ে কৃষকদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। কীটনাশকের মান যাচাইয়ে নিয়োজিত কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ শাখা সূত্র জানিয়েছে, ষাটের দশকের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১২৩ ধরনের কীটনাশক এক হাজার ৩৯০টি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নামে দেশে বাজারজাতকরণের রেজিস্ট্রেশন পেয়েছে। এর মধ্যে কীটনাশক বিধিমালা না মানা এবং মানসম্পন্ন না হওয়ায় ১১১টির রেজিস্ট্রেশন বাতিল হয়েছে। গত বছর বাতিল হয়েছে চারটির (ক্লাইথরিন ১০-এফসি, ডাইওজেনিল টি-৬০, পেসনন ৫৭-ইসি, সিওফেন ২০-ইসি) কীটনাশক আমদানির্নিভর আমদানির পর দেশীয় কম্পানিগুলো তা প্যাকেটজাত করে নিজস্ব নামে বাজারজাত করে থাকে। গত বছর বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) করা কৃষি উপকরণ ব্যবহারে কৃষকের অভিজ্ঞতা শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের ৭৭ ভাগ কৃষক কৃষি উপকরণের (সার. বীজ, সেচ, কীটনাশক) সঠিক ব্যবহার জানেন না; আর অধিকাংশ কৃষকই কীটনাশক প্রয়োগ সম্পর্কে অজ্ঞ। ওই গবেষণায় আরো বলা হয়, দেশের কৃষকরা সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে ফসল সংগ্রহের মাত্র ২-৪ দিন আগে, এমনকি ফসল সংগ্রহের দিনও বালাইনাশক ও কীটনাশক ব্যবহার করে থাকে। ফলে ওইসব বালাইনাশকের রিসিডুয়াল ইফেক্ট মানবদেহে চলে আসে- যা মানবদেহে নানা ধরনের জটিলতা সৃষ্টি করে, জীবনীশক্তি হ্রাস করে এমনকি ক্যান্সারসহ নানাবিদ জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. শহীদুল ইসলাম বলেন, রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার দ্বারা ফসল রক্ষা এবং অতিরিক্ত উৎপাদন হলেও এর পেছনে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়ায় যে স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি হয় এবং পরিবেশ দূষিত হয়, তাতে উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি হচ্ছে। প্রচলিত কীটনাশকের মধ্যে যেগুলো সবচেয়ে ক্ষতিকর, সেগুলো চিহ্নিত করে আমদানি ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করতে হবে। কৃষিবিদদের মতে, রাসায়নিক বালাইনাশকের পরিবর্তে জৈব বালাইনাশক ও আইপিএম পদ্ধতির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব উপায়ে বালাই দমন করা সর্বোত্তম। এতে অর্থের সাশ্রয় হবে, ফসলের উৎপাদন খরচ কমবে এবং মানবস্বাস্থ্য ও পরিবেশ সুরক্ষিত হবে।