ফসলের জাত উদ্ভাবনে জার্মপস্নাজমই ভরসা

প্রকাশ | ২৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০০:০০

ড. মোহাম্মদ রেজওয়ান মোলস্না ও ইফতেখার আহমেদ
উদ্ভিদ ও প্রাণীর দেহে বিভিন্ন ধরনের জিন রয়েছে, যাহা বংশ বৃদ্ধির ইউনিট হিসেবে চিহ্নিত হয় এবং কোষের মধ্যে অবস্থিত ক্রোমোজোমে অবস্থান করে। বিভিন্ন ধরনের জিন কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান বৈশিষ্ট্য বহন করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একটি প্রজাতির সমগ্র জিনগত বৈশিষ্ট্যের ধারকসমূহকে জার্মপস্নাজম হিসেবে অভিহিত করা হয় এবং উদ্ভিদের প্রকৃত ও কার্যকর গুণাগুণসম্পন্ন জার্মপস্নাজমকে উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ সব কৌলিসম্পদ সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে আছে- যা এই পৃথিবীর কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিভিন্ন গবেষণা প্রবন্ধে দেখা গেছে, পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে আজ পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীতে প্রায় তিন লাখ উচ্চ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। যার মধ্যে মাত্র সাত হাজার প্রজাতি মানুষের চাষাবাদের মাধ্যমে অভিযোজিত হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩০ প্রজাতির উদ্ভিদই অধিক চাষাবাদ হচ্ছে- যার মাধ্যমে মানুষের চাহিদার শতকরা ৯৫ ভাগ প্রোটিন ও শর্করা পাওয়া যায়। সাধারণত (১) স্থানীয় জাত, (২) অপ্রচলিত জাত, (৩) আদিজাত, (৪) বন্য ও সমগোত্রীয় আগাছা প্রজাতিগুলোই জার্মপস্নাজম হিসেবে গণ্য করা হয়। বর্তমান বিশ্বে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য অধিক ফলনশীল ফসলের জাত চাষাবাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। খাদ্যের চাহিদা মেটাতে সারা বিশ্ব এমনকি বাংলাদেশও উচ্চ ফলনশীল ও হাইব্রিড জাতের ফসল চাষাবাদে দিকে ঝুঁকছে। বিভিন্ন জৈবিক ও অজৈবিক প্রতিকূলতার কারণে ফসলের ক্ষতি হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রতিকূলতা প্রতিরোধী ফসলের জাতের চাষাবাদও দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। পক্ষান্তরে আদিকাল থেকে চাষ হয়ে আসা জাতগুলো ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা ভুলে যাচ্ছি, এ সব হাইব্রিড কিংবা জৈবিক ও অজৈবিক প্রতিকূলতা প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনের প্রধান বা মূলভিত্তি হচ্ছে উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ-জার্মপস্নাজম বা আদিজাতসমূহ। একইভাবে অভিযোজিত জাতসমূহের কিছু কিছু বিশেষ জিন আছে- যা নতুন ও উন্নত জাত সৃষ্টিতে সহায়তা করে থাকে। ফসলের জাত উন্নয়নের বিভিন্ন আধুনিক পদ্ধতি, যেমন- সংকরায়নের মাধ্যমে হাইব্রিড কিংবা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জিএমও ফসল-ট্রান্সজেনেটিক ফসলের জাত উদ্ভাবনের জন্য বৈচিত্র্যময় জার্মপস্নাজমই একমাত্র ভরসা। তার কারণ নতুন করে কখনো কোনো বৈশিষ্ট্য কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল নানাবিধ রোগ, পোকামাকড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় অক্ষম। সমস্যা মোকাবিলায় বিজ্ঞানীরা প্রতিরোধী জিনের জন্য বৈচিত্র্যময় জার্মপস্নাজমের অপেক্ষায় থাকেন অথবা খুঁজে বের করেন। কেবলমাত্র প্রকৃতিতে বিদ্যমান বিভিন্ন কৌলিতাত্ত্বিক মূল্যবান বৈশিষ্ট্যগুলোকে আধুনিক প্রযুক্তিতে সম্মিলনের মাধ্যমে মানব সভ্যতার/কৃষকের চাহিদা/রুচি অনুযায়ী জাত উদ্ভাবনই একমাত্র উপায়। উপরোক্ত কারণে জার্মপস্নাজমের ভূমিকা আজ বিশ্বের সব দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ, চীন ও ভারতীয় সেন্টার অব অরিজিনের অন্তর্গত হওয়ায় আমাদের দেশেও প্রচুর বৈচিত্র্যময় জার্মপস্নাজম রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, খনিজসম্পদ, বনসম্পদ, মৎস্যসম্পদ, উর্বর জমির মতোই কৌলিসম্পদ কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের একটি মূল্যবান সম্পদ। কৌলিসম্পদ ছাড়া কৃষির উন্নয়ন কল্পনা করা অসম্ভব। ফসলের উচ্চ ফলনশীল, রোগ বা পোকামাকড়, খরা ও লবণাক্ততা প্রতিরোধী জাত উদ্ভাবনে কৌলিসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের কৃষিকে টিকিয়ে রাখা এবং এর উন্নয়নের জন্য কৌলিসম্পদের ভূমিকা অপরিসীম। দিনের পর দিন, এমনকি শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এ দেশের ফসলের আদিজাতগুলো এ দেশীয় আবহাওয়ায় জন্মেছে এবং এ দেশের আবহাওয়ায় সম্পূর্ণভাবে খাপ খেয়ে গেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে এ দেশের কৃষিতে পরিবর্তিত আবহাওয়ায় খাপ খাওয়াতে হলে আদিজাতের অথবা বর্তমানে আবাদকৃত জাতের নতুন ধরনের বৈশিষ্ট্যের জিনসমৃদ্ধ জাত সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। আদিজাতের প্রয়োজনীয় জিন কাজে লাগিয়ে প্রজননের মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে- যা পরিবর্তিত আবহাওয়ায় সফলভাবে চাষের উপযোগী হবে। আন্তর্জাতিক মহলের দুরভিসন্ধিমূলক প্রেসক্রিপশন ও বহুজাতিক কোম্পানির মধুর বচনে অধিক ফসল ফলানোর আত্মঘাতী তৎপরতায় নীতিনির্ধারক থেকে সাধারণ কৃষক সবাই শামিল হয়েছেন। হাইব্রিড জাতসমূহের দৌরাত্ম্যে বর্তমানে আমাদের নিজস্ব অনেক ফসলের যেমন- ধান, ডাল, তেল, ফলমূল ও শাকসবজির আদিজাতের কতগুলো ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে। কতগুলো বিলুপ্তির মিছিলে রয়েছে। এসব আদিজাত বিভিন্ন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় জন্মানো যায়, এগুলো খরা সহিষ্ণু, রোগ বা পোকামাকড় প্রতিরোধী, এমনকি খেতেও সুস্বাদু। অধিকন্তু বসতবাড়ির আশপাশ, রাস্তার ধারে, ঝোপঝাড়ে খাদ্য উপযোগী অনেক বন্যপ্রজাতির গাছপালা, লতা-গুল্ম প্রাকৃতিকভাবেই জন্মাতো। গ্রামের দরিদ্র জনগণ এগুলো সহজেই খেতে পারতো এবং অনেকাংশে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা মেটাতো। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা সম্পর্কিত সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৭ সালে। মূলত (১) বিভিন্ন দেশীয় ফসলের কৌলিসম্পদ জরিপ করা ও দেশের আনাচে-কানাচ থেকে সংগ্রহ করা, (২) এসব কৌলিসম্পদকে বৈশিষ্ট্যায়ন ও মূল্যায়ন করা ও ব্যবহার নিশ্চিত করা, (৩) জীবপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জার্মপস্নাজমের জিনগত বৈশিষ্ট্যায়নের মাধ্যমে বায়োপাইরেসি রোধ করা, (৪) বিএআরআইয়ের অন্তর্গত সব ফসলের জার্মপস্নাজম সংরক্ষণ করা এবং (৫) জার্মপস্নাজম সম্পর্কিত সব তথ্যাদি সঠিকভাবে সংরক্ষণে রাখা। এসব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ কেন্দ্রে কাজ করে যাচ্ছে। এই কেন্দ্রের গবেষকরা দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, গ্রাম ঘুরে বিভিন্ন ফসল যেমন- দানা জাতীয় ফসল, তৈলবীজ ফসল, ডাল ফসল, সবজি জাতীয় ফসল ও মসলা জাতীয় ফসলের দেশীয় জার্মপস্নাজমের বীজ, চারা ও ডাল সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। এরপর সংগ্রহের সব তথ্য সঠিক ও নির্ধারিত ছকে পূরণ করে বীজ, চারা, ডাল সংরক্ষণ করেন। বর্তমান এই কেন্দ্রের সংরক্ষিত জার্মপস্নাজমের সংখ্যা ১১ হাজারের বেশি। সংগৃহীত জার্মপস্নাজমগুলো যে ব্যক্তি/ কৃষক/ প্রতিষ্ঠান থেকে সংগ্রহ করা হয় তার নামেই সেটা লিপিবদ্ধ করা হয়। মুলত গবেষণার কাজে এসব জার্মপস্নাজম বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়। এখানকার আধুনিক মলিকুলার ল্যাবে ফসলের জিনগত বৈশিষ্ট্যায়নের কাজ চলছে- যা আমাদের অতি মূল্যবান জার্মপস্নাজমগুলো পাচার হয়ে যাওয়া রোধ করবে বা চুরি যাওয়া জার্মপস্নাজম শনাক্তকরণে সহায়তা করবে এবং ওই সব জাতের ওপর আমাদের স্বত্ব প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে। পূর্বে ছোট পরিসরে শুরু হলেও বর্তমানে এই কেন্দ্রে প্রায় ১০০,০০০ জার্মপস্নাজম সংরক্ষণের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন দুটি স্বল্পমেয়াদি (তাপমাত্রা ৪-৬০ সে.) ও দীর্ঘ মেয়াদি (তাপমাত্রা -১৮ থেকে- ২২০ সে.) সংরক্ষণ ইউনিট রয়েছে। এসব ইউনিটে সংগৃহীত বীজসমূহ দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। প্রাকৃতিক কারণে কোনো এলাকার ফসল নষ্ট হয়ে গেলেও ওই এলাকার চাষাবাদের উপযোগী ফসলের বীজ সরবরাহ করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় সহায়তা করা হয়ে থাকে। দেশের কৃষিকে যুগোপযোগী করতে হলে ফসলের শুধু আদিজাতই নয়, নতুন বৈশিষ্ট্য আছে এমন জাতসমূহ সংরক্ষণ জরুরি- যা ভবিষ্যত বংশধরদের জন্য এক অনন্য সম্পদ। অতীতে কৌলিসম্পদকে মনে করা হতো জনগণের প্রাকৃতিকসম্পদ কিন্তু ১৯৯২ সালে ধরত্রী সম্মেলনের পর থেকে কৌলিসম্পদ প্রতিটি দেশের নিজস্ব সম্পদ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ইরড়ষড়মরপধষ উরাবৎংরঃু (ঈইউ)-এর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার ১৯৯৪ সালে ঈইউ সনদে স্বাক্ষর করে। এ সনদে নিজ দেশের কৌলিসম্পদের ওপর সংশ্লিষ্ট দেশের সার্বভৌমত্ব (ঝড়াবৎবরমহ ৎরমযঃ) কায়েম করা হয়েছে। এ সনদের প্রধান উদ্দেশ্য প্রতিটি দেশ তার নিজস্ব কৌলিসম্পদ সংরক্ষণ করবে এবং নিজ দেশ তথা মানবজাতির কল্যাণে সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করবে। বিশ্বের কোনো দেশ অন্য দেশের কৌলিসম্পদ ব্যবহার করতে পারবে না। ব্যবহার করতে হলে দ্বিপক্ষীয়/ বহুপক্ষীয় বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে আদান-প্রদান করে গবেষণা বা অন্য কাজে ব্যবহার করা যাবে। কৌলিসম্পদের গুরুত্ব বিবেচনা করে পৃথিবীর বহু দেশ জাতীয় কৌলিসম্পদ ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে এ ধরনের ইনস্টিটিউট এখন পর্যন্ত স্থাপিত হয়নি। সব ফসলের কৌলিসম্পদ/ জার্মপস্নাজম সংগ্রহ, বৈশিষ্ট্যকরণ, সংরক্ষণ, ডকুমেন্টেশন, বিনিময়, সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং এ সংক্রান্ত জাতীয় নীতি প্রণয়ন ও আন্তর্জাতিক চুক্তি স্বাক্ষরের লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র ইনস্টিটিউট স্থাপন অপরিহার্য। তবে আশার কথা, জাতীয় উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ ইনস্টিটিউট আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। আশা করা যায় অত্যন্ত মূল্যবান এ সম্পদ হারিয়ে যাওয়া বা পাচার হওয়ার পূর্বেই বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার একটি জাতীয় উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ ইনস্টিটিউট স্থাপনে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করবেন যার জন্য বিগত প্রায় ২২ বছর ধরে দেশের বিশেষজ্ঞরা চেষ্টা করে চলেছেন। ড. মোহাম্মদ রেজওয়ান মোলস্না ও ইফতেখার আহমেদ: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর।