প্রাণিসম্পদ খাতে ব্যাপক অবদান রাখছে বিএলআরআই -ড. নাথু রাম সরকার

জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন, প্রাণী স্বাস্থ্য এবং প্রাণী খাদ্য গবেষণায় বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট মোট ৯০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য বেশ কিছু প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সফল হয়েছে। গরু হৃষ্টপুষ্টকরণ প্রযুক্তিটি বিএলআরআইয়ের একটি অধিক জনপ্রিয় প্রযুক্তি। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনেক বেকার যুবক-যুবতীসহ গরু হৃষ্টপুষ্টকরণে অনেক ছোট বড় খামারি ও উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই) মহাপরিচালক ড. নাথু রাম সরকার যায়যায়দিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দৈনিক যায়যায়দিনের সাভার প্রতিনিধি মো. আরজু মীর।

প্রকাশ | ০৩ জানুয়ারি ২০২১, ০০:০০

অনলাইন ডেস্ক
ড. নাথু রাম সরকার
বিএলআরআই মহাপরিচালক বলেন, বিদেশ থেকে প্যারেন্টস্টক বাচ্চার আমদানি নির্ভরশীলতা কমানোর লক্ষ্যে বিএলআরআই দেশে প্রথমবারের মতো দেশি আবহাওয়ায় টেকসই ও রোগবালাই প্রতিরোধক্ষম এবং বছরে ২৯০-৩০০টি ডিম উৎপাদনশীল ২টি ডিম পাড়া মুরগির জাত যথা স্বর্ণা ও শুভ্রা উদ্ভাবন করেছে। অতি সম্প্রতি দেশীয় মুরগির কৌলিক মান উন্নয়ন এবং সিলেকটিভ ব্রিডিংয়ের মাধ্যমে বিশেষ ধরনের উৎপাদন ক্ষম 'মাল্টি কালার টেবিল চিকেন (এমসিটিসি)' নামে মুরগির জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে- যা দেখতে এবং স্বাদে অবিকল দেশি মুরগির মতো। নব উদ্ভাবিত এমসিটিটি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ ও বাজারজাতকরণের জন্য আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেডকে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিএলআরআই একটি ফিডমাস্টার অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল অ্যাপিস্নকেশন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে, যা ব্যবহার করে অতি অল্প সময়ে বয়স, লিঙ্গ এবং উৎপাদন অবস্থার ওপর ভিত্তি করে প্রাণীর পুষ্টির চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে রসদ তৈরি করা যায়। এতে খামারের খাদ্যজনিত ব্যয় ১৬ শতাংশ কমে, খামারের দুধ উৎপাদন প্রায় ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। মহাপরিচালক বলেন, দুগ্ধবতী গাভীর খাদ্যে খনিজ পদার্থের অভাব পূরণ করার জন্য 'মিনা মিক্স' নামে একটি খনিজ পদার্থের মিশ্রণ, গো-খাদ্য সংকট নিরসন ও সাশ্রয়ী মূল্যে গো-খাদ্য উৎপাদনের লক্ষ্যে বিএলআরআই ভুট্টা গাছের উচ্ছিষ্টাংশ ও অন্যান্য খাদ্য উপাদানের সংমিশ্রণ কর্নস্ট্র প্যালেট ফিড, গরু এবং ছাগল-ভেড়ার বাচ্চা পালনে স্বল্পব্যয়ে বাচ্চা পালনের জন্য দুধের বিকল্প খাদ্য মিল্ক-রিপেস্নসার এবং স্টার্টার খাদ্য উদ্ভাবন করা হয়েছে। কর্নস্ট্র প্যালেট ফিড প্রযুক্তি লাল মনি অ্যাপেস্না লিমিটেডের কাছে এবং মিনামিক প্রযুক্তি টিব্র্যাকের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। নেপিয়ার ঘাসের চারটি উন্নত জাত 'নেপিয়ার-১, ২, ৩ ও ৪' উন্নিত করা হয়েছে, যার বার্ষিক গড় উৎপাদন হেক্টরপ্রতি ১৫০-১৬০ টন থেকে ২২০-২৮০ টনে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রযুক্তিটি এ দেশে দুধ ও মাংস উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে এবং ঘাস চাষ আঞ্চলিক ভিত্তিতে বাণিজ্যিক আকার ধারণ করেছে। প্রতি বছরে প্রায় ২০-২৪ মিলিয়ন উন্নত জাতের ঘাসের কাটিং সরাসরি খামারিদের মাঝে এবং মিল্ক ভিটা, ব্র্যাক, আরডিআরএসসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে খামারিদের কাছে বিতরণ করা হচ্ছে। এই ঘাস চাষ করে বছরে একর প্রতি ৭৬ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। এছাড়া দুর্যোগ বা সংকটকালীন সময়ে প্রাণী খাদ্যে সবুজ ঘাসের অভাব পূরণে বিভিন্ন ঘাস সংরক্ষণের পদ্ধতি যথা- ডোল পদ্ধতিতে কাঁচা ঘাস সংরক্ষণ, ভেজা খড়, ভুট্টা খড় বা সবুজ ঘাস সংরক্ষণ প্রযুক্তি এবং ইউএমএস, টোটাল মিক্সড রেশন বা টিএমআর ইত্যাদি উদ্ভাবন হয়েছে। শিল্প বিকাশে সহায়ক প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে দুগ্ধবতী গাভীর দুধ জ্বর দমন, দুধের গুণগত মান উন্নয়ন ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে খাদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে ক্যালসিয়াম ফ্যাটি এসিড সল্ট, বাছুর ও ছাগলের বাচ্চার জন্য মিল্ক-রিপেস্নসার, প্রাণীর ওজনের জন্য ডিজিটাল ব্যালেন্স, বিদু্যৎবিহীন এলাকায় মুরগির বাচ্চাকে তাপায়নের জন্য নন-ইলেকট্রিক চিক ব্রম্নডার উলেস্নখযোগ্য। মহাপরিচালক বলেন, এছাড়াও প্রাণী স্বাস্থ্যবিষয়ক উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে প্রাণীর বিভিন্ন রোগের ভ্যাকসিন যথা সালমোনিলা, পিপিআর, গোটপক্স, তাপসহিষ্ণু পপিআর ভ্যাকসিন, এফএমডি ত্রিযোজী টিকার মাস্টার সিড ইত্যাদি উদ্ভাবন হয়েছে। এফএমডি ত্রিযোজী টিকার মাস্টার সিড দেশে বিরাজ মান তিনটি সিরো টাইপের বিরুদ্ধে কার্যকরী, মূল্য সাশ্রয়ী দেশীয় ভাইরাস থেকে প্রস্তুতকৃত দীর্ঘস্থায়ী, রোগ প্রতিরোধ কম হওয়ায় খুরারোগ দমনে মডেল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া রোগ নির্ণয় ও রোগ দমন প্রযুক্তিসমূহ যথা পিপিআর ও গোটপক্স রোগ নির্ণয়ে ও ফিল্টার পেপার ব্যবহারে রক্ত নমুনা সংগ্রহ পদ্ধতি, ভাইরাসের জিন বিশ্লেষণ, জীব-নিরাপত্তা মডেল, এছাড়া এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগের এইচআই পরীক্ষার জন্য এইচআই এন্টিজেন উদ্ভাবন হয়েছে, ফলে দেশে বিরাজমান এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস থেকে তৈরিকৃত এন্টিজেন দিয়ে ভ্যাকসিনকৃত মুরগির এইচআই পরীক্ষার মাধ্যমে এন্টিবডি যাচাই করা হয়। প্রাথমিকভাবে মাঠপর্যায়ে এসব প্রযুক্তির সফল সম্প্রসারণে বিএলআরআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। দেশি ও বিদেশি জাতের মোট ৫৪টি প্রাণীর জাত এবং ৪৮টি উন্নত ফডারের জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়নে গবেষণা বিএলআরআইয়ে পরিচালিত হচ্ছে। বিএলআরআই জন্মলগ্ন থেকে মোট ১৫টি গবেষণাধর্মী উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে এবং বর্তমানে ৬টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান আছে। এছাড়া জাতীয় স্বার্থে যুগোপযোগী উন্নত গবেষণা ও প্রাণিসম্পদের উন্নয়নের লক্ষ্যে আরো মোট ৮টি উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে। রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটের মাধ্যমে গবেষণার উন্নয়নের লক্ষ্যে দেশে বার্ডফ্লু রোগসহ নতুন ধরনের সংক্রামক পোলট্রি রোগ শনাক্ত ও গবেষণা করার জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা মহাপরিচালক বলেন, সংবলিত ন্যাশনাল এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা রেফারেন্স ল্যাবরেটরি, দক্ষিণ এশিয়াঞ্চলীয় দেশগুলো থেকে ছাগলের পিপিআর রোগদমনে একটি মানসম্পন্ন খাদ্য নিরাপত্তা ল্যাবরেটরি হিসেবে অ্যান্টি-মাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ল্যাবরেটরি স্থাপিত হয়েছে যার মাধ্যমে পোল্ট্রি ও প্রাণিজ আমিষ খাদ্যের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের উপস্থিতি সঠিক শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া মূল কেন্দ্রসহ আঞ্চলিক কেন্দ্রে গবেষণা খামার ও আঞ্চলিক প্রাণী স্বাস্থ্য ও পুষ্টি ল্যাব নির্মাণ, পোলট্র্রি ডিজিস ডায়াগনস্টিক ল্যাবরেটরি, গবেষণা খামারের বর্জ্য ব্যবহারে বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য ১০ কেভি বিদু্যৎ উৎপাদনক্ষম একটি বায়ো গ্যাস বিদু্যৎ পস্নান্ট, সোলারপস্নান্ট স্থাপন করা হয়েছে। গবেষণার পাশাপাশি বিএলআরআই মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। প্রতি বছর প্রায় ২০০০ জন খামারি/উদ্যোক্তাকে প্রযুক্তিভিত্তিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে বিজ্ঞানী/কর্মকর্তাগণকে বিষয়ভিত্তিক দেশে ও বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। বিএলআরআই দেশি ও বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহিত ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের গ্রামীণ উন্নয়ন প্রশাসনের কাছে থেকে বাংলাদেশের অর্জন, এজি এগ্রো লিমিটেড কর্তৃক বাংলাদেশে প্রাণী ও পোলট্রি সেক্টরে গবেষণা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা পদক ও প্রাণিসম্পদ খাতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে 'স্টার্ন্ডাড চ্যার্টার্ড-চ্যানেল আই এগ্রো অ্যাওয়ার্ড'-২০১৯ অর্জন করেছে বিএলআরআই। বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি (এপিএ) বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠানটি গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দ্বিতীয় এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে অর্জন করেছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক ড. নাথু রাম সরকার মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে শুদ্ধাচার পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার খাদ্য, দারিদ্র্যবিমোচন এবং কর্মসংস্থানে বিশেষ করে বেকার যুবক ও মহিলাদের কর্মসংস্থানে তাৎক্ষণিক অবদান রাখার জন্য প্রাণিসম্পদের প্রবৃদ্ধির হার ১৫.০ শতাংশে উন্নীত করা একান্ত প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য স্বপ্নের সোপান রচনা করেছেন, যথা- ভিশন-২০২১, ২০৩০-এমডিজি অর্জন, ভিশন-২০৪১, ২০৭১ স্বাধীনতার ১০০ বছর এবং ২১০০ ডেল্টাপস্ন্যান। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট উন্নয়নের অগ্রাযাত্রার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্বপ্নে রসোপানসমূহের বাস্তব রূপ দিতে বদ্ধপরিকর। ১৯৮৪ সালে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ২৮নং অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)-এর কর্মযাত্রা ১৯৮৬ সালে শুরু হয়। জাতীয় কৃষি গবেষণা সিস্টেমের একটি ইনস্টিটিউট হিসেবে বিএলআরআইয়ের ৯নং আইনটি বিগত ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক বলবৎ করা হয়। গ্রামীণ দারিদ্র্য নির্মূল, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, খাদ্য ও পুষ্টি ঘাটতি পূরণ, আয়বৃদ্ধি, প্রাণিজ আমিষের উৎপাদন বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন এবং প্রাণিজ কৃষি উন্নয়নকে উপজীব্য করে স্বাবলম্বী ও মেধাসম্পন্ন জাতি গঠনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের প্রাণিসম্পদের উন্নয়নে জাতীয় চাহিদার নিরীখে গবেষণা পরিচালনা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের অভীষ্টলক্ষ্য বিএলআরআই কিছু লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে নিরবছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে, যথা- উন্নততর গবেষণা পরিচালনা ও টেকসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন, উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মাধ্যমে খাদ্য ও প্রাণিজ পুষ্টির ঘাটতি পূরণ, সম্ভাবনাময় দেশি প্রাণিসম্পদের সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন, প্রাণিসম্পদ পালনে দক্ষ মানবসম্পদ গঠন এবং দারিদ্র্যবিমোচন। সাভারের মূল কেন্দ্রে ৮টি গবেষণা বিভাগ ও একটি সাপোর্ট সার্ভিস বিভাগ এবং ৫টি আঞ্চলিক কেন্দ্র নিয়ে ইনস্টিটিউটটি দায়িত্ব পালন করছে।