বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাখনার পুষ্টিগুণ, ব্যবহার ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

ডক্টর মোহাম্মদ রেজওয়ান মোলস্না
  ১৪ মার্চ ২০২১, ০০:০০

মাখনা বা কাটা পদ্ম যার ইংরেজি নাম ঋড়ীহঁঃ, শাপলা (ঘুসঢ়যধবধপবধব) পরিবারের ঊঁৎুধষব একটি জলজ বীরুৎ জাতীয় উদ্ভিদ। ঊঁৎুধষব গনের এটিই একমাত্র প্রজাতি। এর বৈজ্ঞানিক নাম ঊঁৎুধষব ভবৎড়ী এটি আমাদের দেশি গাছ হওয়া সত্ত্ব্বেও আমাদের দেশে এর তেমন কদর নেই। চীন, জাপান, মিয়ানমার, কোরিয়া ও ভারতে জন্মে এ জলজ উদ্ভিদ। চীনে প্রায় ৩০০০ বছর যাবৎ মাখনা চাষের রেকর্ড আছে।

মিঠা পানির জলাধার, ঝিল বিশেষভাবে উন্মুক্ত পানির জলাভূমি বা বিলে মাখনা জন্মে। মাখনা কাটাযুক্ত শালুকের মতো উদ্ভিদ- যার শিকড় ও কন্দ পানির নিচে মাটিতে সন্নিবিষ্ট থাকে, পাতা প্রায় গোলাকার, পানির উপরে ভেসে থাকে। আমাজন লিলির পর এটির পাতা দ্বিতীয় বৃহৎ। এদের ফুল আকারে শাপলার চেয়ে ছোট। ভেতরে উজ্জ্বল লাল রং, বাইরের দিকে সবুজ ও উজ্জ্বল বেগুনি রংয়ের। ফল গোলাকার বা ডিম্বাকৃতির এবং বাইরের অংশ কাটাযুক্ত। মাখনার ফল কচি এবং পরিপক্ব উভয় অবস্থাতেই খাওয়া যায়। ফলের ভেতরে ছোলার দানার মতো ছোট ছোট বীজ থাকে এবং এর খোসা ছাড়ানোর পর সাদা অংশটি খেতে হয়। এটি মিষ্টি স্বাদের। প্রতিটি ফলে ২০টি পর্যন্ত বীজ থাকে। শাপলা, শালুক, পদ্ম কিংবা চাঁদমালার সঙ্গে মিলেমিশে জন্মাতে পারে। এগুলো শহরে দুর্লভ হলেও গ্রামে গেলে পুকুরে, খাল, বিলে এখনো দেখতে পাওয়া যায়। পুরান ঢাকার অনেকের কাছেই এটি খুব প্রিয় ফল। মাখনা আমাদের দেশের সিলেট ও কিশোরগঞ্জের বিল-ঝিলে পাওয়া যায়। মৌলভীবাজার ও নওগাঁর কিছু এলাকায়ও এ ফলটি দেখা যায়।

পুষ্টিতথ্য: মাখনার পুষ্টির কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো এটি স্নেহ পদার্থ এবং কোলস্টেরল শূন্য। এ কারণে যাদের হাটের সমস্য আছে তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ স্নাক্স বা জল খাবার। মাখনাতে ভালো পরিমাণ প্রোটিন আছে- যা শরীরের পেশির টিসু্য গঠনে কাজে লাগে। অধিক পরিমাণ পটাশিয়াম এবং কম সোডিয়াম থাকার ফলে বিশেষত যারা হাইপার টেনশন বা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন তাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্যে করে। প্রতি ১০০ গ্রাম মাখনাতে শক্তির পরিমাণ ৩৫০ কিলোক্যালরি, স্নেহ পদার্থ-০.১ গ্রাম, প্রোটিন-৯.৭ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট-৭.৭ গ্রাম, ফাইবার বা আঁশের পরিমাণ-৭.৬ গ্রাম। বিভিন্ন খনিজের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য পরিমাণে সোডিয়াম- ২১০ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম-৫০০ মিলিগ্রাম এবং ক্যালশিয়ামের পরিমাণ-৬০ মিলিগ্রাম।

স্বাস্থ্য উপকারিতা : দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, পস্নীহার সমস্যা, যকৃতের অসুখ এবং ডায়বেটিস জাতীয় অসুখের প্রতিকারে প্রাচ্যের চিকিৎসায় বহুদিন যাবত মাখনা ব্যবহৃত হচ্ছে। স্বাস্থ্যের জন্য বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত মাখনার উপকারিতা কী কী দেখা যাক-

ডায়বেটিসের জন্য- মাখনার মধ্যে প্রচুর তন্তু থাকায় খাবার খাওয়ার অনতিবিলম্বে রক্তে শর্করা বৃদ্ধি হতে দেয় না। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হওয়ার দরুন ডায়বিটিসের জটিলতা বাড়তে দেয় না।

হার্টের জন্য- উচ্চ মাত্রায় পটাশিয়াম থাকার কারণে মাখনা রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। যেহেতু এর মধ্যে স্নেহ পদার্থ কম থাকে সে কারণে আপনার কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ে না। অ্যারিথমিয়া মাইয়োকার্ডিয়াল ইসকিমিয়া এবং হার্টের অন্যান্য সমস্যার ঝুঁকি কমায়।

হাড়ের জন্য- মাখনা হচ্ছে একটি ক্যাশিয়ামসমৃদ্ধ খাদ্য এবং সে কারণে হাড় ভাঙার এবং ব্যথার ঝুঁকি কমায় একই সঙ্গে হাড়ের শক্তিবৃদ্ধি করে।

যকৃতের সমস্যার জন্য- যকৃতের একাধিক সমস্যা যেমন প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারা, কিডনি বিকল হওয়া বা পরিইউরিয়া জাতীয় অসুখের চিরাচরিত চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ধরে এই ফলগুলো ব্যবহার হয়ে আসছে। কিডনির সমস্যার উন্নতিতেও এগুলো কাজ করে তবে যদি এমন হয় যে আপনি দীর্ঘদিন কিডনির সমস্যায় ভুগছেন তাহলে ব্যবহারের আগে অবশ্যই আপনার চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করবেন।

বন্ধ্যাত্বের জন্য- যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মাখনা ভালো কাজ করে এবং এমন প্রমাণও মিলেছে যে, পুরুষ এবং নারী উভয়ের ক্ষেত্রেই বন্ধ্যাত্বের সমস্যার উন্নতিতে সাহায্য করে।

অন্যান্য ব্যবহার : মাখনার ফল ও বীজ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মুখরোচক খাবার তৈরি হয়। সবার প্রিয় ফুচকাতে মাখনা ব্যবহৃত হয়। এটির ব্যবহারে ফুচকা ভালো ফুলে ও মচমচে হয়। ভারতে বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মাখনার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে এবং নবরাত্রির সময় এটি খাওয়া হয়। চীনের চিরাচরিত চিকিৎসা পদ্ধতিতে এবং আয়ুর্বেদে গত ৩০০০ বছর ধরে মাখনা ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

\হমনে রাখতে হবে: প্রচুর স্বাস্থ্যকর উপাদান থাকা সত্ত্বেও কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন: এলার্জি, পেট ফাপা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। তাই দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় এই খাবার অন্তর্ভুক্ত করতে চাইলে আপনার চিকিৎসক বা পুষ্টি বিশারদের সঙ্গে পরামর্শ করুন।

শেষ কথা : বাংলাদেশ উদ্ভিদ ও প্রাণিজ্ঞান কোষের নবম খন্ডে (আগস্ট ২০১০) মাখনা প্রজাতির সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এদের সংকটের কারণ মাত্রাতিরিক্ত আহরণ ও আবাসস্থল ধ্বংস এবং বাংলাদেশে এটির সংরক্ষণ ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগৃহীত হয়নি, কিন্তু বিরল প্রতীয়মান। বাংলাদেশে মাখনা সংরক্ষণের জন্য কোনো পদক্ষেপ সংগৃহীত হয়নি। প্রজাতিটির সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয়েছে যে, সমৃদ্ধ ভক্ষণীয় বীজের জন্য জনসাধারণকে এটি চাষাবাদে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।

লেখক: ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, উদ্ভিদ কৌলিসম্পদ কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে