শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শিং মাছ চাষে নীরব বিপস্নব

ইমরান সিদ্দিকী
  ২১ মার্চ ২০২১, ০০:০০

বাঙালির মৎস্যগত প্রাণ। এক সময় বাংলাদেশ ছিল মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পুকুর ভরা মাছ, গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু ছিল বাঙালির পরিচয়। কালক্রমে 'মাছে ভাতে বাঙালি'র প্রবাদটি হারিয়ে যেতে বসেছিল। দেশে আবার সুদিন ফিরেছে মাছের। গ্রামবাংলার অতি পরিচিত একটি মাছ শিং। নদী, পুকুর, খাল-বিলে প্রাকৃতিকভাবেই শিং মাছ পাওয়া যেত। রোগীর পথ্য হিসেবে চিকিৎসকরা শিং মাছের ঝোল খাবার কথা বলেন। প্রায় হারিয়ে যাওয়া শিং মাছ চাষের মাধ্যমে আবার ফিরে এসেছে।

শিং মাছ এখন পরিচিতি পেয়েছে চাষের মাছ হিসেবে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক মৎস্যচাষি বাণিজ্যিকভাবে শিং মাছ চাষাবাদ করছেন। অনেকেই প্রচলিত পদ্ধতিতে একই পুকুরে শিং মাছের সঙ্গে অন্য মাছও চাষ করেন। তাদের লক্ষ্য থাকে অল্প সময়ের মধ্যে একই পুকুর থেকে অধিক আয় করা। নিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষে আগ্রহ বেড়েছে ময়মনসিংহ অঞ্চলের মাছ চাষিদের। কম জমিতে অধিক ঘনত্বে মাছচাষে বেশি লাভ হওয়ায় দিন দিন বাড়ছে চাষির সংখ্যা। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ৬০টিরও বেশি মৎস্যচাষ প্রযুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে নিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষ পদ্ধতি চাষিদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) দীর্ঘ গবেষণার পর শিং মাছের নতুন এ চাষ পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে। পদ্ধতিটির নাম শিং মাছের নিবিড় চাষ। সাধারণত দেশজুড়ে আধা নিবিড় পদ্ধতিতে শিং মাছ চাষ করা হয়। এতে একাধিক প্রজাতির মাছ একসঙ্গে একই পুকুরে বড় হয়। তবে নতুন এ পদ্ধতিতে একই পুকুরে শিং মাছের সঙ্গে অন্য কোনো প্রজাতির মাছ চাষ করা যাবে না। এ পদ্ধতিতে শুধু স্ত্রী শিং চাষ করলে ব্যাপক সাফল্য পাওয়া সম্ভব হবে। আমাদের দেশে মাছ চাষ একটি লাভজনক পেশা। মাছ চাষ করে অনেকেই তাদের দরিদ্রতা দূর করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। মাছ চাষের ক্ষেত্রে নিবিড় পদ্ধতি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।

শিং মাছের নিবিড় চাষের জন্য ২০-৫০ শতাংশ আয়তনের ছায়াযুক্ত পুকুর নির্বাচন করা যেতে পারে, যেখানে বছরে কমপক্ষে ৭-৮ মাস ১.৫০ থেকে ২.০ মিটার পানি থাকে। শিং মাছ নিবিড় চাষের জন্য প্রথমত পুকুর ভালোভাবে শুকাতে হবে। শুকানোর পর তলদেশের পচা কাদা অপসারণ করতে হবে এবং পাড় ভালোভাবে মেরামত ও মজবুত করতে হবে। তলদেশ ছয় থেকে সাত দিন রৌদ্রে শুকাতে হবে। পরবর্তী সময়ে তলদেশ থেকে ক্ষতিকারক জীবাণু ধ্বংস করার লক্ষ্যে প্রতি শতাংশে ২০-৩০ গ্রাম বিস্নচিং পাউডার ভালোভাবে ছিটিয়ে দিতে হবে। বিস্নচিং পাউডার প্রয়োগের ৩-৫ দিন পরে পুকুর বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ১.৫ মিটার পর্যন্ত পূর্ণ করতে হবে। পানি পূর্ণ করার পর শতাংশপ্রতি ০.৫-১.০ কেজি কলিচুন পানিতে মিশিয়ে দ্রবণ তৈরি করে পুকরে প্রয়োগ করতে হবে। চুন প্রয়োগের ৩ দিন পরে পোনা মজুতের ব্যবস্থা নিতে হবে।

আশার কথা হলো, বর্তমানে আমাদের দেশের মৎস্য খামারিরা কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সফলভাবে পোনা উৎপাদন করায় শিং মাছকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে পেরেছে। পুকুরে শিং মাছ চাষ একটি লাভজনক ব্যবসা। ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার ধলা এলাকার মৎস্য চাষিরা শিং মাছ চাষ করে আর্থিকভাবে সচ্ছলতা অর্জন করেছন। শিং মাছ নতুন- পুরাতন উভয় পুকুরেই চাষ করা যায়। পুরাতন পুকুরেই শিং মাছ চাষ ভালো হয় নতুন পুকুরের চেয়ে। শিং মাছের পুকুর উর্বর না হলে অনেক সময় শিং মাছ আঁকা-বাঁকা হয়ে যায়।

শীতকালে শিং মাছের রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখার জন্য প্রতি ১৫ দিন পরপর পুকুরের পানি পরিবর্তন করে দিতে হয়। সঙ্গে প্রতি মাসে একবার হলেও এন্টিফাঙ্গাস মেডিসিন ব্যবহার করতে হবে। পানির উচ্চতা ২ ফুটে রাখতে পারলে ভালো। শিং মাছের পুকুরে গ্যাস দূর করার জন্য কোনো অবস্থাতেই হররা টানা যাবে না। হররা টানা হলে মাছ খাবার ছেড়ে দেয় এতে আরো বেশি গ্যাসের সৃষ্টি হয়। পুকুরের তলদেশের অ্যামোনিয়া গ্যাস দূর করার জন্য গ্যাসোনেক্স ব্যবহার করা যেতে পারে। শিং মাছের জন্য অধিক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। শিং মাছ পুকুরের তলদেশের জলজ কীট খেয়ে থাকলেও লাভজনক চাষে মানসম্মত সম্পূরক খাবার দিতে হবে। খাবারে কমপক্ষে ৩২ ভাগ প্রোটিনসমৃদ্ধ হতে হবে। এ ক্ষেত্রে কারখানার প্রস্তুকৃত মানসম্মত খাবারই উত্তম। বেশি ভালো হয় ভাসমান খাবার প্রয়োগ করলে। এ ক্ষেত্রে পুকুরের তলদেশে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ বজায় থাকে।

মাছ সংগ্রহের সঠিক নিয়ম: পুকুরে অন্যান্য মাছ জাল টেনে ধরা গেলেও কিন্তু শিং মাছ জাল টেনে ধরা যায় না। শিং মাছ ধরার জন্য শেষরাতের দিকে পুকুরের পানি সেচ দিয়ে শুকিয়ে নিতে হবে। শিং মাছ ধরার সঠিক সময় হলো ভোরবেলা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত। রোদের সময় শিং মাছ ধরা যাবে না; কারণ রোদের সময় শিং মাছ ধরলে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এ বিষয়ে বিএফআরআইয়ের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডক্টর এইচ এম কোহিনুর যাযাদিকে বলেন, এ ধরনের চাষাবাদের ক্ষেত্রে পুকুরকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে যাতে পুকুরের পানি কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। এ ক্ষেত্রে সপ্তাহে ৪ থেকে ৫ দিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হয়। ক্ষতিকর জলজ প্রাণির প্রবেশ রোধে পুকুরের চারপাশে ফিল্টার জাল দিয়ে বেষ্টনী দেওয়া যেতে পারে। খামারে চাষকালীন সময়ে মাছ রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি এড়াতে পুকুরের জৈব নিরাপত্তা ও রোগ প্রতিরোধী কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। সাধারণত পোনা মজুতের ছয় থেকে সাত মাস পর মাছ আহরণ করতে হয়। এ সময়ে মাছের গড় ওজন ৫৫ থেকে ৬৫ গ্রাম ওজনের হয়ে থাকে। পুকুর পুরোপুরি শুকিয়ে শিং মাছ আহরণের ব্যবস্থা করতে হবে। এ পদ্ধতি অনুসরণে ৫০ শতাংশের পুকুরে ৭ মাসে ৮ থেকে ৯ টন শিং মাছ উৎপাদন করা যায়।

দেশের স্বাদু পানিতে ২৬০ প্রজাতির মাছ রয়েছে। এ ছাড়া খাঁড়ি অঞ্চল ও লোনা পানিতে কয়েকশ' প্রজাতির মাছ আছে। এর মধ্যে রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভারকার্প, গ্রাসকার্প, কালিবাউস, সরপুঁটি, নাইলোটিকা, পাঙাশ ইত্যাদির চাষ হচ্ছে পুকুর, খাল, ডোবা ও ঘেরে। এর পাশাপাশি পাবদা, গুলশা, তেলাপিয়া, কই, শিং, মাগুর, শোল, টাকি, টেংরা মাছ ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে।

জাতিসংঘ খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বলছে, বর্তমানে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। এফএওর হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের ৫৭ শতাংশ শুধু মাছ থেকেই মেটানো হয়। দেশের জনসাধারণের আমিষের চাহিদাপূরণ, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্য বিমোচনসহ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে মৎস্যসম্পদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। গত তিন দশকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মাছচাষে উৎপাদন ২৫ গুণ বেড়েছে। রপ্তানি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে