সবজি চাষে বোরন সারের ব্যবহার

জমিতে মাটির উপরের স্তরের তুলনায় নিচের স্তরেই বোরন বেশি থাকে। বিশেষ করে বেলে বা বেলে দো-অঁাশ মাটিতে সেচের পানির সঙ্গে বোরন চঁুইয়ে মাটির নিচের দিকে চলে যায়। এজন্য এ ধরনের মাটিতে বোরন সার প্রয়োগের চেয়ে পাতায় প্রয়োগ বেশি কাযর্কর। তবে অন্য ধরনের মাটিতে বিশেষ করে ভারী মাটি বা চুন মাটিতে বোরন বেশি লাগে। বোরন সার প্রয়োগ করা যায়...

প্রকাশ | ০৭ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

কৃষিবিদ খোন্দকার মো. মেসবাহুল ইসলাম
বাংলাদেশে যত ধরনের সবজি চাষ হয়, এসব সবজির মধ্যে সব সবজিরই সব ধরনের সারের প্রয়োজন সমান নয়। যেসব সার ফসলের জন্য কম লাগে কিন্তু একেবারেই ব্যবহার না করলে বা নিধাির্রত মাত্রায় ব্যবহার না করলে ফসলের জন্য সমস্যার সৃষ্টি হয়। সেই সারগুলোর মধ্যে বোরন অন্যতম। বোরন সার পরিমিত মাত্রায় ব্যবহারে যেমন ফলন বাড়ে তেমনি অতিরিক্ত ব্যবহারে ফসলের ক্ষতি হয় ও ফলন মারাত্মকভাবে কমে যেতে পারে। তাই বোরন সার ব্যবহারে খুবই সতকর্ থাকতে হয়। তেল ফসল হিসেবে বাংলাদেশে সরিষার চাষই প্রধান। প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার চাষ হয়ে থাকে। যা থেকে প্রায় সাড়ে চার লাখ মে. টন সরিষা বীজ উৎপাদন হয়। যা থেকে প্রায় পৌনে দুই লাখ মে. টন ভোজ্য তেল পাওয়া যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, সরিষা চাষে বোরন সার ব্যবহার করলে শতকরা ১৯.৮-২৩.০ ভাগ পযর্ন্ত ফলন বৃদ্ধি পায়। এজন্য হেক্টরপ্রতি মাত্র ১৫০-২০০ টাকা খরচ করে অতিরিক্ত প্রায় ৭-৮ হাজার টাকা আয় করা সম্ভব। শীত মৌসুমে যেসব সবজি চাষ করা হয় সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু সবজির বোরনের চাহিদা লক্ষ্য করা যায়। এসব সবজির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ বেগুন, টমেটো, ফুলকফি, বঁাধাকপি, শিম, বরবটি, মটরশুঁটি, মূলা, আলু, গাজর, শালগম, বীট, সরিষা শাক, পালং শাক, পেঁয়াজ ইত্যাদি। জমিতে মাটির উপরের স্তরের তুলনায় নিচের স্তরেই বোরন বেশি থাকে। বিশেষ করে বেলে বা বেলে দো-অঁাশ মাটিতে সেচের পানির সঙ্গে বোরন চঁুইয়ে মাটির নিচের দিকে চলে যায়। এজন্য এধরনের মাটিতে বোরন সার প্রয়োগের চেয়ে পাতায় প্রয়োগ বেশি কাযর্কর। তবে অন্য ধরনের মাটিতে বিশেষ করে ভারী মাটি বা চুন মাটিতে বোরন বেশি লাগে। বোরন সার প্রয়োগ করা যায়। পাতায় প্রয়োগ করলে প্রতি লিটার পানিতে ১.৫-২.০ গ্রাম এবং মাটিতে প্রয়োগ করলে ৩-৪ কেজি বোরন সার প্রয়োজন হয়। পাতায় স্প্রে করলে বীজ বোনার বা চারা রোপণের ২০-২৫ দিন এবং ৪০-৪৫ দিন পর স্প্রে করতে হয়। বোরন পাতায় স্প্রে করার অসুবিধা হলোÑ অভাবজনিত লক্ষণ দেখা দেয়ার পর এটি যখন প্রয়োগ করা হয়, তখন ফসলের বেশ কিছু ক্ষতি হয়ে যায়। একটা ফসলে বোরন ব্যবহার করার পরের ফসলে ব্যবহার করতে হয় না। তৃতীয় ফসল চাষের সময় প্রয়োজন বুঝে আবার ব্যবহার করতে হয়। বোরনের অভাবে বাড়ন্ত আলুগাছের ডগার পাতা পুরু হয় ও কিনারা বরাবর ভিতরের দিকে গুটিয়ে গিয়ে অনেকটা কাপের আকৃতি ধারণ করে। এই সব পাতা ভঙ্গুর হয়। আলুগাছের শিকড়ও গুটিয়ে যায়, গাছ দুবর্ল হয়। আলু ছোট আকারের হয়, খোসা খসখসে ও তাতে ফাটা ফাটা দাগ দেখা যায়। কখনো কখনো আলুর কন্দের ভেতরে বাদামি দাগ দেখা যায়। বোরনের অভাবে টমেটোর চারা গাছে সবুজ রঙের পরিবতের্ কিছুটা বেগুনি রং লক্ষ্য করা যায়। বাড়ন্ত টমেটোগাছের ডগার কুঁড়ি শুকিয়ে মরে যায়। পাতা এবং পাতার বৃন্ত পুরু ও ভঙ্গুর হয়। কাÐ খাটো হয়ে পুরো গাছ ঝোপালো হয়ে যায়। ফল বিকৃত হয় ও খোসা খসখসে হয়ে ফেটে যায়। বোরনের অভাবে বেগুনগাছের বৃদ্ধি কমে যায়। ফুল সংখ্যায় কম আসে এবং ফুল ঝরা বৃদ্ধি পায়। ফল আকারে ছোট হয় ও ফল ফেটে যায়। কখনো কখনো কচি ফল ঝরে পড়ে। বোরনের অভাবে শিম ও বরবটির নতুন বের হওয়া পাতা কিছুটা পুরু ও ভঙ্গুর হয়। পাতার রং গাঢ় সবুজ ও শিরাগুলো হলদে হয়ে যায়। শেষে পাতা শুকাতে শুরু করে, গাছে ফুল দেরিতে আসে ও শুঁটি বীজহীন হয়। বোরনের অভাবে ফুলকপির চারার পাতা পুরু হয়ে যায় এবং চারা খাটো হয়। ফুল বা কাডের্র উপরে ভেজা ভেজা দাগ পড়ে। পরে ওই দাগ হালকা গোলাপি এবং শেষে কালচে হয়ে ফুলটিতে পচন ধরে। পাতার কিনারা নিচের দিকে বেঁকে যায় ও ভঙ্গুর প্রকৃতির হয়। পুরনো পাতা প্রথমে সাদাটে এবং পরে বাদামি হয়ে কিছুটা উঁচু খসখসে দাগে পরিণত হয়। কাটলে আক্রান্ত অংশ থেকে এবং ফুলকপি রান্নার পর এক ধরনের দুগর্ন্ধ বের হয়। বঁাধাকপির মাথা বঁাধা শুরু হওয়ার সময় দেখা যায় যে মাথা বঁাধছে না এবং ভেতরটি ফঁাপা হয়ে যায়। একেবারে ভেতরের কচি পাতাগুলো বাদামি রঙের হয় এবং পচন ধরে। কাÐের ভেতরের মধ্যাংশ ফঁাপা হয় ও পচে যায়। বোরনের অভাবে মরিচ বা মিষ্টি মরিচের কচি পাতা হলুদ হয়ে এবং ফুল বা কচি ফলও ঝরে পড়ে। গাছের বৃদ্ধি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। বোরনের অভাবে সরিষার বীজ গঠন ঠিকভাবে হয় না। হেক্টরপ্রতি ১.৫ কেজি বোরন প্রয়োগ করলে সরিষার বীজ উৎপাদন প্রায় ৫৯% পযর্ন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে (হালদার ও অন্যান্য, ২০০৭)। জাত, মাটি, স্থান (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল) ও মাটিতে রসের তারতম্য অনুসারে বোরন সার হিসেবে পানিতে গুলে নিয়ে স্প্রে করতে হয়। পানিতে মিশিয়ে প্রয়োগ করলে নিধাির্রত মাত্রার অধের্ক পরিমাণ সার প্রয়োজন হয়। এ জন্য ১০-১৫ দিন পর পর ২-৩ বার বোরন সার স্প্রে করা যেতে পারে। জমিতে সরাসরি বোরন সার প্রয়োগ করা যায়। সে ক্ষেত্রে টিএসপি, এমওপি, জিপসাম, জিংক অক্সাইড ও বোরন সারের সবটুকু এবং ইউরিয়ার অধের্ক পরিমাণ শেষ চাষের সময় মাটিতে প্রয়োগ করতে হয়। বাকি ইউরিয়া গাছে ফুল আসার সময় উপরি প্রয়োগ করে একবার পানি সেচ দিতে হয়। বোরন সার হিসেবে ব্যবহারের জন্য ফলিরিয়েল, সলুবোর, লিবরেল বোরন, আলফা বোরন ইত্যাদি পাওয়া যায়। এ ছাড়া দানাদার বোরিক এসিড ও বোরাক্স বা সোহাগা (সোডিয়াম টেট্রাবোরেট) বোরন সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। লেখক : উদ্যান বিষেশজ্ঞ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, রংপুর অঞ্চল, রংপুর