প্রকৃতিনিভর্র জুম
এখন জুমের পাকা ধানে পাহাড় ভরপুর। পাকা ধান বাড়িতে তোলা নিয়ে ব্যস্ত জুমিয়ারা। জুম হলো পাহাড়ের ঢালে বিশেষ পদ্ধতিতে জঙ্গল পরিষ্কার করে ফসল ফলানো। সমতল ভ‚মিতে যেমন প্রতি বছর ফসল ফলানো যায়, জুমে কিন্তু একই পাহাড়ে প্রতি বছর ফসল ফলানো যায় না। একবার জুম চাষ করার পর ওই পাহাড়টি ৪-৫ বছর পতিত রাখার পর আবার একই পাহাড়ে জুম চাষ করা হয়। কৃষিবিজ্ঞানীরা জুম চাষকে বলেন, স্থানান্তরিত কৃষি এবং কেউ কেউ পযার্য়ক্রমিক চাষও বলে থাকেন। চাষ পদ্ধতি এক হলেও বিভিন্ন স¤প্রদায়ের কাছে জুম চাষ আলাদা নামে পরিচিত। জুম চাষকে চাকমা ভাষায় জুম, মারমা ভাষায় ইয়ঁা, ত্রিপুরা ভাষায় হুগ, ম্রো ভাষায় উঃঅ, খিয়াং ভাষায় লাই, বম ভাষায় লাও বলা হয়। পাহাড় বাছাই থেকে ফসল ঘরে তোলা পযর্ন্ত জুমচাষিরা কয়েকটি ধাপে এ কাজ সম্পন্ন করে। এ ধাপগুলো হলো- দুজ মারা, জুম ফাঙ গরানা, জঙ্গল কাটা, জুম পোড়ানা, আরা কাজানা, মোনঘর তৈরি, আনুনী কাটা, বী খের সুরো, বীজ বপন, দুজ মারা, মধ্যসুলো ও মেইড সুলো, পেগরাগানা, ধান কাটা ফাঙ ও নোভাত খাওয়া, অন্যান্য ফসল তোলা। জুমের ফসলের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নানাজাতের ধান, কুমড়া, অড়হড়, শিম, শশা, করলা, ঢেঁড়শ, তিল, ভুট্টা, আদা, যব, তুলা, হলুদ, পাহাড়ি আলু, কচু, ইত্যাদি। বলা হয়ে থাকে, পাহাড়িরা প্রকৃতির সন্তান। জুম চাষও সম্পূণর্রূপে প্রকৃতির ওপর নিভর্র করে। জুমিয়ারা চাষে কোনো লাঙল অথবা কোদাল ব্যবহার করে না। বীজ বপনের পর কোনো রকম রাসায়নিক সার, কীটনাশক অথবা আধুনিক কোনো সেচও ব্যবহার করা হয় না। আর তাই জুমে উৎপাদিত সবজি, ফলমূল হয় খুবই সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যসম্মত। জানুয়ারি-ফেব্রæয়ারি মাসে জুম প্রস্তুত করার জন্য গাছপালা কাটা হয়। মাচর্-এপ্রিলের দিকে শুকনা গাছপালা আগুনে পুড়িয়ে ধানসহ বিভিন্ন ফসলের বীজ বপন করা হয়। জুলাই থেকে ডিসেম্বর মাস পযর্ন্ত জুমের ফসল কাটার মৌসুম।
জুম ফসল তোলার ভর মৌসুম
মৌসুমে উপযুক্ত জলবায়ু ও বৃষ্টিপাতের কারণে এবং ইঁদুরের উৎপাত কমে যাওয়ায় ভালো ফলন হয়েছে। কোনো সমস্যা ছাড়াই জুমের সোনালি ফসল ঘরে তুলতে পারায় জুম্ম নারী-পুরুষ ফিরে পেয়েছে মুখের হাসি। জুমিয়াদের ঘরে ঘরে জুমের সোনালি ফসল তোলার আনন্দ। পাবর্ত্য অঞ্চলের পাহাড়ি মানুষের জীবিকার আদিম ও প্রধান উৎস এ জুম চাষ। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ৮০ ভাগই জুম চাষনিভর্র। তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৮১৮ সালের আগে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে জুম চাষই একমাত্র কৃষিচাষ পদ্ধতি ছিল। কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে তিন পাবর্ত্য জেলা ৫ হাজার ৪৮০ বগির্কলোমিটার অশ্রেণিভুক্ত বনভ‚মির সিংহভাগেই জুম চাষ করা হয়। তিন জেলার কমবেশি ৪৩ হাজার পরিবার জুম চাষনিভর্র। এর মধ্যে খাগড়াছড়ির প্রায় ২২ হাজার, রাঙামাটির প্রায় ১০ হাজার ও বান্দরবানে প্রায় ১৩ হাজার জুমিয়া পরিবার আছে। বাংলাদেশের একমাত্র তিন পাবর্ত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে এ জুম চাষ করা হয়। তিন জেলার প্রায় ২৫ হাজার ৪শ হেক্টর পাহাড় ভ‚মিতে জুম চাষ হয়েছে এবার। ধুম পড়েছে মারফা, বেগুন, ধানি মরিচ, ঢেঁড়শ, কাকরোল, কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল তোলার কাজ। এরপর ঘরে উঠবে তিল, যব এবং সব শেষে তোলা হবে তুলা। পাহাড়ে পাহাড়ে চলছে এখন নতুন ধানে নবান্ন উৎসব।
পাহাড়ে নতুন কৃষি ’ক্রিক’
ক্রিক অথর্ হলো দুই অথবা তিন পাহাড়ের সঙ্গে বঁাধ দিয়ে জলাধার তৈরি করা। পাবর্ত্য চট্টগ্রামে মৎস্য চাষ উন্নয়ন ও স¤প্রসারণে পাহাড়ের পতিত জমিতে ক্রিকের মাধ্যমে মাছ চাষসহ অন্যান্য চাষাবাদে দীঘের্ময়াদি প্রকল্প নিয়ে পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে মৎস্য বিভাগ। মৎস্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পাবর্ত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার ২৫ উপজেলায় দুই পাহাড়ের মাঝে ক্রিকের (ঘোনায় মাছচাষের জন্য বঁাধ) মাধ্যমে অথার্ৎ পাহাড়ি ঘোনায় মৎস্য চাষের এ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। ইতোমধ্যে প্রায় ৯৫টি ক্রিক নিমার্ণ করা হয়েছে। আরো তিন শতাধিক ক্রিক নিমাের্ণর জন্য কাযাের্দশ দেয়া হয়েছে। সব ক্রিক নিমার্ণ শেষ হলে শিগগিরই পাবর্ত্য এলাকায় মাছচাষের মাধ্যমে ব্যাপক কমর্সংস্থানের সৃষ্টি হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সবাই। ক্রিক পদ্ধতির সুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মাছ চাষ করা। তাছাড়া ক্রিকের পানি দিয়ে গৃহস্থালির কাজ করা, খাবার পানির ব্যবস্থা করা হয়। আর যে বঁাধটা দেয়া হয়, তার সুবিধা নিয়ে শাক-সবজি চাষ করা, বঁাধের ওপর যাতায়াতের সুযোগ তৈরি করা। মৎস্য বিভাগ পাহাড়ের মানুষকে এ কাজে সম্পৃক্ত করেছে। এ কাজের মাধ্যমে পাহাড়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুফলভোগীরা মাছ চাষের পাশাপাশি হঁাস-মুরগি পালন, শাক-সবজির চাষ করে অনেকটাই স্বাবলম্বী হয়ে উঠেতে শুরু করেছে। এখন জুমচাষের পাশাপাশি নতুন ’ক্রিক পদ্ধতিতে চলছে পাহড়ের কৃষি।
ফল চাষে ঝুঁকছেন পাহাড়িরা
জুম চাষে ফলন কম হওয়ায় পাহাড়িরা আম ও আনারসসহ বিভিন্ন মৌসুমি ফল চাষ করছেন। ফলে পাবর্ত্য এলাকায় বেড়েছে ফল উৎপাদন। পাহাড়ে বাড়ছে বিদেশি ফল ড্রাগনের চাষ। স্বল্প সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় বান্দরবানে জুম চাষ ছেড়ে ড্রাগন ফল চাষে ঝুঁকছেন পাহাড়িরা। চিম্বুক পাহাড়ের বসন্ত পাড়ায় বাণিজ্যিকভাবে ড্রাগন ফলের চাষ করে লাভবান হয়েছেন অনেকে। বান্দরবান কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যে জানা যায়, বিদেশি ফল হলেও পাহাড়ের জলবায়ু এবং মাটি দুটিই ড্রাগন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। পাহাড়ে ড্রাগন ফল চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। পোকামাকড়ের আক্রমণ কম এবং পানির সেচ কম লাগায় এ চাষে আগ্রহী হচ্ছে পাহাড়িরা। আম্রপালি জাতের বাগান স্থাপনে পাহাড়ি এলাকায় এক বিপ্লব সৃষ্টি হয়েছে। এখানে পোকামাকড়ের উপদ্রব কম হওয়া ও মাটিতে রসের অভাবের কারণে এ আমের মিষ্টতা বেশি, যা অন্য জেলাতেও যথেষ্ট সমাদৃত। বাগানি আমের ভালো দাম পাচ্ছে, আবাদে আরও উৎসাহিত হচ্ছে। এখানে সীমিত আকারে রাঙ্গুয়াই নামক আমের বারমিজ জাতটির স¤প্রসারণ হচ্ছে। পাহাড়ি এলাকায় প্রচুর মাল্টা-কমলা, বাতাবি ও অন্যান্য লেবুজাতীয় ফলের আবাদ দেখা যায়। পাবর্ত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের পাহাড়িদের জীবন-জীবিকার অন্যতম উৎস কলা চাষ। আগে অনেকটা নিম্নমানের চঁাপাকলা কম যতেœ আবাদ করা হতো। এখন দৃশ্য অনেকটা পাল্টাচ্ছে। বাংলাকলা আবাদ প্রাধান্য পাচ্ছে। তিন পাবর্ত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের দুগর্ম এলাকায় বসবাসরত আদিবাসী পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বেশিরভাগ লোকজন নিভর্রশীল কলা চাষের ওপর। পাহাড়ি এলাকায় লম্বা জাতের বহু বছরজীবী এক জাতের পেঁপে চাষ প্রচলন আছে। মূলত বসতবাড়ি ও জুমের ফঁাকে সীমিত আকারে এ ফলের চাষ চলছে। জুম চাষ তাদের জীবিকার আদিম পেশা হলেও তা আবাদ হয়ে থাকে বছরে কেবল এক মৌসুমে। কিন্তু কলা চাষ করে ফলন পাওয়া যায় বছরজুড়ে সব মৌসুমে। রাঙামাটি কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, আগে জুম চাষে প্রচুর ফলন পাওয়া গেলেও দিন দিন ফলন কমছে। এর ফলে পাহাড়িরা ফলের বাগান চাষে ঝুঁকছে। একইসঙ্গে বেড়েছে আদা ও হলুদ চাষ। এতে কৃষক লাভবানও হচ্ছে।
লেখক: কৃষি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক
