কৃষকবন্ধু ‘আইয়ুব ভাই’

প্রকাশ | ২১ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

এম আর মাসুদ
শ্রেষ্ঠ উপসহকারী কৃষি কমর্কতার্ আইয়ুব হোসেন
সারাদিন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সূযর্ দেখা মেলেনি একটুও। তারপরও দিনটা ছিল সাপ্তাহিক ছুটির দ্বিতীয় দিন শনিবার। বেলা তিনটার দিকে নিজ কপি ক্ষেতে কাজ করছিলেন কৃষক জামির হোসেন। এ সময় দূর থেকে জামির ভাই বলে ডাক দিয়ে কাদামাটি মাড়িয়ে ক্ষেতে হাজির হলেন আইয়ুব হোসেন। ঘটনাটি গত ১৩ অক্টোবর যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালী ইউনিয়নের বোধখানার মাঠে। তাকে দেখে এগিয়ে এলেন বোধখানা গ্রামের খ্রিস্টানপাড়ার পঞ্চাশোধ্বর্ বয়সী কৃষক নীলমনি বিশ্বাস। জানলেন বৃষ্টিতে কপিক্ষেতে করণীয় বিষয়াদি। আইয়ুব হোসেন সম্পকের্ নীলমনি জানান, দাদা তো বন্ধের দিন হোক আর বৃষ্টির দিন হোক মাঠে আসবেই। সকালে আসে আর রাতে যায়। আমাদের সাথে তার রোজ দেখা হয় মাঠে। এতক্ষণ যে আইয়ুব হোসেনের কথা বলছিলাম, তিনি হলেন ঝিকরগাছার বোধখানা বøকের উপ-সহকারী কৃষি কমর্কতার্ । ২০১২ সালের এপ্রিল মাসে আইয়ুব হোসেন ওই বøকের দায়িত্বে আসেন। ৬ বছরের মধ্যে তিনি এই বøকের কৃষিতে ঘটিয়েছেন বিপ্লব। আধুনিক ও টেকসই প্রযুক্তির সমন্বয়ে বøকের কৃষিতে এসেছে ব্যাপক সাফল্য। অথচ একসময় ছিল এখনকার কৃষিতে ভগ্নদশা। লোকসান গুনতে হতো কৃষকদের। সে অবস্থা কাটিয়ে কৃষিতে রীতিমতো মডেলে রূপান্তরিত হয়েছে এই বøক। ২০১৬ সালে বিষমুক্ত (নিরাপদ) সবজী উৎপাদনে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত কৃষক বোধখানা গ্রামের আলী হোসেন জানান, আইয়ুব ভাই শিখিয়েছেন কিভাবে নিরাপদ সবজি উৎপাদন ও আদশর্ বীজতলা তৈরি করতে হয়। ফলন বাড়াতে লাইন লোগো পদ্ধতির ব্যবহার। লাইন লোগো পদ্ধতিতে দশ লাইন পর পর এক লাইন ফঁাকা রাখা। ক্ষতিকর পোকা দমনে পাচির্ং, সেক্সফেরমন ফঁাদ, পোকার উপস্থিতি নিরূপণে আলোক ফঁাদসহ জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে এই বøকের কৃষকদের অভ্যস্থ করেছেন তিনি। ওই বøকের বোধখানা ও বারবাকপুর গ্রামকে ‘ভামির্ কম্পোস্ট ভিলেজ’ হিসেবে গড়ে তুলেছেন আইয়ুব হোসেন। কয়েক বছর আগেও এই বøকের কৃষকেরা অধিকাংশ জমিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে ফসল ফলাতেন। কিন্তু আইয়ুব হোসেন শিখিয়েছেন, বাড়ির অঙিনায় পড়ে থাকা উপকরণ দিয়েই কিভাবে সার তৈরি করে রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা যায় এবং এই সার ফলনের জন্য কতটা ভালো। ওই বøকে বতর্মান ২৫৮ জন নারী ১৭৫৫টি চাড়িতে (নান্দা) বছরে ১৪৪ মেট্রিকটন ভামির্ কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছেন। যার বতর্মান বাজারমূল্য প্রায় ১৫ লক্ষ টাকা। এ ছাড়া ট্রাইকো কম্পোস্ট, চালা কম্পোস্ট পদ্ধতিতেও সার তৈরি করা হচ্ছে। বারবাকপুর গ্রামের কৃষানি অনোয়ারা বেগম জানান, আইয়ুব হোসেন ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় তিন বছর আগে ভামির্ কম্পোস্ট সার তৈরি শুরু করি। বতর্মানে ১২০টি চাড়িতে (নান্দা) মাসে ১৬-১৭ মণ ভামির্ কম্পোস্ট সার তৈরি হয়। এ থেকে প্রতি মাসে আমার আয় আসে ৬-৭ হাজার টাকা। যা দিয়ে কলেজপড়–য়া দুই ছেলের লেখাপড়ার খরচ যোগানোসহ সংসারে এসেছে সচ্ছলতা। একই গ্রামের শিক্ষাথীর্ নাসরিন সুলতানা জানান, আইয়ুব ভাইয়ের কারণে প্রতি মাসে তার আয় ৫-৬ হাজার টাকা। নাসরিনও ১১৫টি চাড়িতে (নান্দা) ভামির্ কম্পোস্ট সার তৈরি করেন। কৃষানি হোসনে আরার দাবি আইয়ুব ভাইয়ের বদৌলতে ভামির্ কম্পোস্ট ও বসতভিটায় সবজি চাষ করে যে অথর্ পেয়েছে, তা দিয়ে স্বণার্লঙ্কার ও গরু কিনেছেন। বানিয়েছেন পাকা রান্নাঘর। বারবাকপুর মহিলা সিআইজি সমিতির সভাপতি ইয়াসমিন বেগম জানান, আইয়ুব ভাইয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমরা আজ আথির্কভাবে স্বাবলম্বী। বতর্মানে আমাদের সমিতির মূলধন প্রায় দুই লক্ষ টাকা। আমাদের প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে ভামির্ কম্পোস্ট ও বসতভিটায় নিরাপদ সবজি উৎপান করা হয়। জানা গেছে, আইয়ুব হোসেন ওই বøকে জাতীয় কৃষিপ্রযুক্তি প্রোগ্রামের (এনএটিপি-২) অধীনে তিনটি রেজিস্ট্রিশনকৃত সিআইজি (ফসল) গ্রæপ করেছেন। এদের মূলধনেও রয়েছে প্রায় চার লক্ষ টাকা। কৃষকদের নিয়ে আইপিএম ও আইএফএমসি ক্লাব করেছেন ৩টি। সঞ্চয় হিসাবে এসব কৃষকদের পঁুজি এখন প্রায় চৌদ্দ লক্ষ টাকা। এ সকল ক্লাবের কৃষকদের উৎপাদিত ভামির্ কম্পোস্ট থেকে কেঁচো আলাদা করার জন্য উপজেলা প্রশাসন থেকে দুইটি ভামির্ কম্পোস্ট সেপারেটর মেশিন ও ভুট্টা মাড়াই যন্ত্র প্রদান করা হয়েছে। এ ছাড়া গড়ে উঠেছে কৃষিপণ্য সংগ্রহ ও বাজার জাত করণ কেন্দ্র (সিসিএমজি)। উপজেলা কৃষি কমর্কতার্ দীপঙ্কর দাশ জানান, আইয়ুব হোসেন একজন দক্ষ, অভিজ্ঞ ও কমর্ঠ কমর্কতার্। তার প্রচেষ্টায় ওই বøকে কৃষিতে বিপ্লব ঘটেছে। আইয়ুব তার পেশাকে শুধু চাকরি হিসেবে নেয়নি, একজন সুনাগরিক হিসেবেও তার কতর্ব্য পালন করছেন। সে এই অফিসের শ্রেষ্ঠ উপসহকারী কৃষি কমর্কতার্ ও সারাদেশের ‘বেস্ট আইপিএম ’সহায়তাকারী হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন। গদখালী ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল ইসলাম রিফাত জানান, আইয়ুব হোসেন মাঠের মানুষ। তিনি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের গবর্ ও কৃষকের বন্ধু। তার কারণে প্রতি নিয়ত ইউনিয়নের বোধখানা বøকের কৃষি কাযর্ক্রম প্রদশের্ন দেশ বিদেশের অনেক ঊধ্বর্তন কমর্কতার্র আগমন ঘটে। যশোর অঞ্চলের কৃষিসম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (এডি) চÐি দাস কুÐু বলেন ‘আইয়ুব হোসেন শুধু একজন কৃষি কমর্কতার্য় সীমাবদ্ধ না, সে নিজেকে কৃষি ও কৃষকের পেছনে উৎসগর্ করেছে’।