খাটো জাতের নারিকেল

সম্প্রতি সাভারের রাজালাখ হটির্কালচার সেন্টারে সরেজমিন পরিদশের্ন দেখা যায় ৩ বছর পঁাচ মাস বয়সী একটা নারিকেল গাছে শতাধিক নারিকেল ধরেছে। এ বিষয়ে সাভার হটির্কালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত¡বিদ কৃষিবিদ শেখ ইফফাত আরা ইসলাম বলেনÑ ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে পরীক্ষামূলক এখানে একটি খাটো জাতের নারিকেল গাছের চারা রোপণ করা হয় এবং রোপণের ২৮ মাসের মাথায় নারিকেল গাছে ফুল আসা শুরু হয়...

প্রকাশ | ২৮ অক্টোবর ২০১৮, ০০:০০

এস এম মুকুল
ভিয়েতনাম থেকে সরকারিভাবে আমদানিকৃত দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রোপণ করা খাটো জাতের নারিকেল গাছে তিন বছরেই ফল ধরেছে। এ নিয়ে নারিকেল চাষিদের মাঝে নতুন আগ্রহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। সম্প্রতি সাভারের রাজালাখ হটির্কালচার সেন্টারে সরেজমিন পরিদশের্ন দেখা যায় ৩ বছর পঁাচ মাস বয়সী একটা নারিকেল গাছে শতাধিক নারিকেল ধরেছে। এ বিষয়ে সাভার হটির্কালচার সেন্টারের উদ্যানতত্ত¡বিদ কৃষিবিদ শেখ ইফফাত আরা ইসলাম বলেনÑ ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসের ১০ তারিখে পরীক্ষামূলক এখানে একটি খাটো জাতের নারিকেল গাছের চারা রোপণ করা হয় এবং রোপণের ২৮ মাসের মাথায় নারিকেল গাছে ফুল আসা শুরু হয়। এখন এই গাছে শতাধিক ডাব ধরেছে এবং নতুন নতুন অসংখ্য ফুল বের হচ্ছে। নারিকেল দেশের অন্যতম অথর্করী ফসল। নারিকেল গাছের পাতা, ফুল, ফল, শিকড় সব কিছুই বিভিন্ন ছোট-বড় শিল্পের কঁাচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বতর্মান সরকার সারাদেশে বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের উপক‚লীয় জেলাগুলোর পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর অথৈর্নতিক উন্নয়নে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করছে। এইসব এলাকায় নারিকেল চাষের জন্য অতি অনুক‚ল অবস্থা বিরাজ করছে। এই বিবেচনায় ভিয়েতনাম থেকে খাটো ও উন্নতজাতের ওপেন পলিনেটেড নারিকেলের চারা আমদানি করে ব্যাপক আকারে সম্প্রসারণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হতে পারেন অধিক লাভবান অনুসন্ধানে জানাগেছে, খাটো জাতের হাইব্রিড নারিকেল গাছের চাষে গুরুত্ব দিচ্ছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এই নারিকেল গাছ সনাতনী গাছের তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি ফল দিবে। চারা রোপণের দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যেই ফল পাওয়া যাবে। নতুন উদ্ভাবিত এ নারিকেল গাছ বছরে ১৫০ থেকে ২৫০টি ফল দিয়ে থাকে। যা দেশি নারিকেল গাছের তুলনায় তিন থেকে পঁাচ গুণ বেশি। গাছের উচ্চতা ২ থেকে ৪ ফুট হলেই ফল ধরা শুরু করে। বাংলাদেশে দুটি খাটো জাতের নারিকেল গাছের চাষ হয়। একটি হলো ডিজে সম্পূণর্ হাইব্রিড ডোয়াফ নারিকেল এবং অন্যটি হলো ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা ‘উন্নত ও খাটো‘ ওপেন পলিনেটেড (ওপি) জাত। ভিয়েতনাম থেকে সংগ্রহ করা এ জাতটি আবার দু-ধরনের, সিয়াম গ্রিন কোকোনাট এবং সিয়াম বøু কোকোনাট। দুটি জাতই বছরে প্রায় ১৫০টি নারিকেল দেয়। এই জাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো নারিকেল থেকেই এর চারা হবে। দুই থেকে আড়াই বছরে গাছে ফুল আসবে। প্রতিটি ডাব থেকে ৩০০ এমএল পানি পাওয়া যাবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার নারিকেল ও ডাবের চাহিদা পূরণে ভিয়েতনাম থেকে আমদানি করা খাটো জাতের নারিকেলগাছ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় লাগানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের পরিচালক ড. মেহেদী মাসুদ বলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নিদের্শনায় ২০১৬ সালের মাচর্ মাসে ভিয়েতনাম থেকে সরাসরি এই খাটো জাতের নারিকেলের চারা আমদানি করা শুরু হয় এবং ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় সোয়া সাত লাখ চারা বিতরণ করা হয়েছে। তিনি জানান এই নারিকেল গাছে অনেক নারিকেল ধরে অল্প সময়ে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রোপণ করা অনেক গাছেই ফুল আসা শুরু হয়েছে এবং এই নারিকেল গাছ দিন দিন বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সারাদেশে এই নারিকেল গাছের অসংখ্য বাগান সৃজন করা হয়েছে এ ছাড়া সরকারী হটির্কালচার সেন্টার ও উপজেলা কৃষি অফিসের থেকে প্রতিটি চারা ৫০০ টাকা দরে ক্রয় করে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই এই নারিকেল গাছের বাগান করেছেন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হটির্কালচার উইংয়ের পরিচালক কৃষিবিদ মিজানুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে অতিমাত্রায় ডাব বিক্রি হওয়ায় নারিকেলগাছের ফল বা (বীজ) প্রাপ্তির সংখ্যা দিন-দিন কমে আসছে। এ পরিস্থিতিতে ভিয়েতনাম থেকে খাটো জাতের ওপেন পলিনেটেড নারিকেলের চারা আমদানি করা হয়েছে। এ জাতের ডাব খুবই সুস্বাদু। এ ছাড়া ফলনও লম্বা জাতের গাছের চেয়ে অনেক বেশি। এ গাছে বছরে গড়ে ১৫০ থেকে ২০০টি ফল ধরে। গাছ রোপণের দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে ফুল ফোটা শুরু হয়। সব ধরনের মাটিতেই এ গাছ লাগানো সম্ভব। তাছাড়া এ জাতের গাছ লবণাক্ততা অনেক বেশি সহ্য করতে পারে। গাছ খাটো হওয়ায় পরিচযার্ও সহজ। খাটো জাতের নারিকেল চাষে করণীয় আমাদের দেশে বতর্মানে যে প্রচলিত নারিকেলগুলো রয়েছে তা থেকে ফলন পেতে স্বাভাবিকভাবে ৭ থেকে ৮ বছর সময় লাগে। নিকাশযুক্ত দো-অঁাশ থেকে বেলে দো-অঁাশ মাটিতে ডিজে সম্পূণর্ ডোয়াফর্ হাইব্রিড নারিকেল রোপণের সময় জুন-সেপ্টেম্বর। রোপণের দূরত্ব : ৬ বাই ৬ মিটার হিসেবে হেক্টরপ্রতি ২৭৮টি চারা প্রয়োজন। আদশর্ পিটের মাপ হবে ৩ ফুট বাই ৩ ফুট বাই ৩ ফুট। গতর্ তৈরির পর প্রতি গতের্ ১৫ থেকে ২০ কেজি পচা গোবর অথবা আবজর্না পচা সার দিতে হবে। মাটিতে অবস্থানরত পোকার আক্রমণ থেকে চারা রক্ষার জন্য প্রতি গতের্ ৫০ গ্রাম বাসুডিন প্রয়োগ করতে হবে। সব কিছু মাটির সাথে মিশিয়ে গতর্ ভরাট করে দিতে হবে। ভরাটের পর পানি দিয়ে গতর্টাকে ভিজিয়ে দিতে হবে যাতে সব সার ও অন্যান্য উপাদান মাটির সঙ্গে মিশে যায় যা চারা গাছের শিকড়ের বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। নারিকেল গাছের মাঝখানে বারি মাল্টা-১ বা লেবু, ডালিম, আমড়া, সফেদা জাতীয় গাছ লাগিয়ে নারিকেল চাষকে আরো অথর্বহ করে তোলা যায়। সূত্র জানায়, বরিশাল, বরগুনা, পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বাগেরহাট, খুলনা, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া, মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় খাটো জাতের নারিকেল গাছ লাগানো শুরু হয়েছে। এ ছাড়া বান্দরবান, রাঙামাটি জেলার পাহাড়ি এলাকায়ও এ জাতের গাছ লাগানো হয়েছে। সারা দেশে হটির্কালচার সেন্টারের মাধ্যমে এ চারা কৃষকের মাঝে বিতরণ করা হয়। রাজধানীতে আসাদগেট হটির্কালচার সেন্টার থেকেও এ জাতের গাছ সংগ্রহ করছেন রাজধানীবাসী। জানাগেছে, ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে যারা খাটো জাতের এই নারিকেলের চারা রোপণ করে নিয়মিত সঠিকভাবে পরিচযার্ করেছেন তাদের প্রায় সকলের গাছেই নারিকেলের ফুল আসা শুরু হয়েছে। মাওনা গাজিপুরের কনের্ল গোলাম মওলা, চন্দ্রার মো. আতিকুল ইসলাম, চুয়াডাঙ্গার মো. আকবর আলী, হারিছ উদ্দিন, হটির্কালচার সেন্টার রহমতপুর, বরিশাল, হটির্কালচার সেন্টার রামু কক্সবাজার, কাশিয়ানী হটির্কালচার সেন্টার, মাগুরা হটির্কালচার সেন্টার ও বারাদি, মেহেরপুরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আড়াই বছরের গাছেই ফুল আসা শুরু হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার কৃষি কমর্কতার্ তালহা জুবাইর মাসররুরের কাছে খাটো জাতের এই নারিকেল চাষ বিষয়ে কৃষকদের মাঠপযাের্য় কী ধরনের পরামশর্ দিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেনÑ খাটো জাতের নারিকেল গাছ থেকে ৩ বছরেই ফল পেতে হলে গাছ লাগানো থেকে শুরু করে সারা বছর নিয়ম মেনে পরিচযার্ করতে হয়। রোদ্দজ্জল ছায়া পড়েনা এবং সেচের ভাল ব্যবস্থা আছে এমন জায়গা নিবার্চন করে মাত্রানুযায়ী জৈব ও রাসায়নিক সার দিয়ে মাদা তৈরি করে গাছ লাগাতে হবে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এই নারিকেল গাছের চারা রোপণকারীদের সবধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। লেখক : কৃষি বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক